"অব্যক্ত স্পর্শহীন ভালোবাসা!!


২৬শে জানুয়ারি ২০০১, বাংলাদেশে প্রথমবারের মত পা রাখলো ইনাতা। অথচ এখানে আসার পর থেকেই মেয়েটার মনে হচ্ছে তার খুব আপন কোন জায়গায় সে ফিরে এসেছে। অন্যরকম একটা পূর্ণতা কাজ করছে ইনাতার মনে। গত সেপ্টেম্বরেই ইনাতার পড়াশোনা শেষ হয়েছে। ইনাতার বাবা চেয়েছিলেন পড়াশোনা শেষ করে নিজের ইচ্ছামতো ইনাতা যে কোন একটা জায়গায় ঘুরে আসুক। পৃথিবীর এত দর্শনীয় জায়গা ছেড়ে মেয়েটা বাংলাদেশকেই বেছে নিল। প্রথমে রাজি না হলেও মেয়ের দিকে তাকিয়ে ইনাতার বাবাকে রাজী হতে হয়। অবশ্য ইনাতার বাংলাদেশে আসতে চাওয়ার কারণও আছে।
যেই সময়টাতে ইনাতা বাংলাদেশে দাঁড়িয়ে তার থেকে পুরোপুরি ২২ বছর আগে ইনাতার মা রুবিনা ইরানী বংশদ্ভুত জার্মান নাগরিক ম্যাক্স বার্চ'কে ভালোবেসে বিয়ে করার অপরাধে পরিবার থেকে সারাজীবনের জন্য বিতাড়িত হন। ইনাতার জন্মের পর রুবিনার সংসার আলোয় ভরে গেলেও মাঝে মাঝেই তার বাবা মা ভাই বোনের জন্য লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদা এখনো প্রায় ইনাতার চোখে ভাসে। যদিও তার পরিবারে ভালোবাসার কোন কমতি ছিলনা। বাংলাদেশের সবার ভবিষ্যতবাণী মিথ্যা করে দিয়ে তার বিদেশী স্বামী নিয়ে অনেক সুখেই কাটছিল দিন। কিন্তু ভাগ্যে বোধহয় অন্যকিছুই লিখা ছিল। ইনাতার যখন ৭ বছর বয়স মারাত্নক এক সড়ক দুর্ঘটনায় পড়ে রুবিনা। মৃত্যুর আগেও রুবিনার চেহারায় বাবা মা কে কষ্ট দেওয়ার অপরাধবোধ ছিল, আর ছিল তাদেরকে একবার দেখার আকুতি...
নানার বাড়ি সম্পর্কে তেমন কিছুই জানেনা ইনাতা। ইনাতার বাবারও তেমন কোন ধারনা নেই। শুধু জানে রুবিনা চট্রগ্রামের এক বিত্তশালী সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের কন্যা ছিল। অবশ্য তাদেরকে খুঁজে পাওয়ার আশায় ইনাতা এখানে আসেনি। এসেছে তার মা যে শহরটায় বড় হয়েছে সেই শহরটা একবার দেখে যেতে। দশ দিনের জন্য সে বাংলাদেশে এসেছে। আসার আগেই সে তার বাংলাদেশী বন্ধু মুহিতকে ই-মেইলে আসার ব্যাপারে সবকিছু জানিয়ে দিয়েছিল। মুহিতও জবাবে বলেছিল যে সে অনেক খুশি ইনাতা বাংলাদেশে আসবে এবং যে কয়দিন ইনাতা এখানে থাকবে তাকে সময় দেওয়ার ব্যাপারে পুরোপুরি আগ্রহ দেখিয়েছে মুহিত। মুহিত ইনাতার একমাত্র বাংলাদেশী বন্ধু। বাংলাদেশ নিয়ে তীব্র আগ্রহ থাকায় ইনাতা অনেক আগ থেকেই ইন্টারনেটে বাংলাদেশী বন্ধু করার চেষ্টা করত। কারো সাথেই বেশীদিন বন্ধুত্ব জমেনি শুধু মুহিত ছাড়া। কিন্তু মুহিতের বাসায় নেট কানেকশন না থাকায় তাদের মধ্যে খুব বেশী যোগাযোগ হতো না। ইনাতা মুহিতকে বিকাল চারটায় তার হোটেল এর সামনে আসতে বলেছিল। চারটা বাজার দশ মিনিট আগেই সে নিচে নেমে এসে অপেক্ষা করতে লাগলো। অল্প কিছুক্ষনের মধ্যেই ইনাতা দেখল হেলেদুলে হাটতে হাটতে মুহিত এগিয়ে আসছে। কাছে এসে ইনাতাকে দেখে একমুহূর্তের জন্য বাকরুদ্ধ হয়ে গেল মুহিত। ছবিতে যতটুকুন না মনে হয়েছে তার থেকেও অনেক অনেক বেশি সুন্দর ইনাতা। মুহিতের মনে হল নীল জিন্সের সাথে সাদা টিশার্ট আর ব্ল্যাক কোট পরে একটা পরী দাড়িয়ে আছে যা বাদামী চোখগুলোতে একবার তাকালে সহজে দৃষ্টি ফেরানো মুশকিল।
নিরবতা ভেঙ্গে দিয়ে ইনাতাই প্রথম কথা বলল-
-হাই মুহিত, তুমি কেমন আছো ?
-ভালো আছি ইনাতা। তুমি ভালো আছো ?
- হ্যা ভালো। আমি খুব খুশি হয়েছি তুমি এখানে এসেছ।
আসতে তো হবেই ।তোমাকে দেখার এত বড় সুযোগটা কিভাবে মিস করি।
- তাই? চল , কোথাও যাই...
ঠিক আছে।চল...
এক কথায় ঠিক আছে বললেও এই পরী'টাকে নিয়ে যাবার জন্য উপযুক্ত জায়গা কোথায় আছে এই শহরে মুহিত নিজেও জানেনা। সন্ধ্যা পর্যন্ত তারা উদ্দেশ্যহীন ভাবে ঘুরল। পরদিন কোথায় কোথায় যাবে সেই প্ল্যানও করল। সন্ধ্যায় ইনাতাকে হোটেলে নামিয়ে দিয়ে ফেরার সময় মুহিতের অদ্ভুত মন খারাপ হয়ে গেল। কিছুতেই ইনাতার চেহারা তার মন থেকে সরছিলনা। তারপর নিজেকেই নিজে শাসন করল এই বলে যে ,ইনাতা শুধুই তার বন্ধু মেয়েটা অনেক আবেগ নিয়ে এদেশে এসেছে ,তাকে বিশ্বাস করেছে । কোনভাবেই ইনাতা কষ্ট পাক এমন কোন কাজ করা যাবেনা।
পরদিন নির্দিষ্ট সময়ে আবার তাদের দেখা হল ।সারাদিন মুহিত ইনাতাকে চট্রগ্রাম শহরের অনেক জায়গা দেখালো।পাহাড়ে ঘিরে থাকা শহরটাকে দেখে ইনাতা মুগ্ধ হচ্ছিল আবার মাঝে মাঝে কেমন জানি বিষণ্ণ হয়ে যাচ্ছিল। দ্বিতীয় বারের মত ইনাতার সাথে সারাদিন কাটিয়ে মুহিত বুঝতে পারলো জন্ম থেকে জার্মান বড় হওয়া মেয়েটা মায়ের সান্নিধ্য খুব বেশী না পেলেও তার ভেতরেও যেন এক বাঙ্গালী মেয়েই বাস করে। ভীষণ মার্জিত,লাজুক আর মিষ্টভাষী ইনাতা। ইনাতার ব্যবহারে বোঝা যেত সেও মুহিতের ব্যবহার, ভদ্রতায় ভীষণ মুগ্ধ। এক সপ্তাহের মধ্যে ইনাতাকে মুহিত পুরো চট্রগ্রাম শহর ঘুরে দেখিয়েছিল। এর মধ্যে ইনাতা অনেক শপিংও করেছিল। তার বন্ধুদের জন্য গিফট কিনেছিল। দেখতে দেখতে চট্রগ্রামে ইনাতার শেষ দিন ঘনিয়ে আসলো । সেদিন তাদের পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতে যাওয়ার প্ল্যান ছিল। মুহিত ইনাতার জন্য অপেক্ষা করছিল। ইনাতা যখন আসল মুহিতের বিস্ময়ের সীমা রইলনা। ইনাতার পরনে ছিল নীল রঙ্গা জামদানি শাড়ি ,চোখে কাজল, কপালে লালটিপ, বাদামী চুলগুলো পিঠময় ছড়ানো ছিল। সারাক্ষন ইনাতার সাথে থাকলেও মুহিত টেরই পায়নি ইনাতা কখন শাড়ি কিনেছে।
শাড়ি কিভাবে পরলে ইনাতা?
- আমি পরতে পারিনা। অনেক কঠিন পরা। পার্লার থেকে পরেছি। খারাপ হয়েছে?
নাহ... ঠিকই আছে...
- তাহলে তুমি এভাবে তাকাচ্ছ কেন?
একটু অবাক হয়েছিলাম তাই। ঠিক আছে চল ।হাটতে পারছ তো ঠিক মত?
- হ্যা। পারছি।
নীল শাড়ি পরা ইনাতা যখন সমুদ্র পাড়ে হাটছিল মুহিতের মনে মনে ভাবছিল তার থেকে দুর্ভাগা বোধহয় পৃথিবীতে আর কেউ নেই। কাল থেকে ইনাতা তার ধরা ছোঁয়ার বাইরে চলে যাবে অথচ এখন এত কাছে যে হাত বাড়ালেই ছুঁতে পারবে। তার খুব খুব ইচ্ছে করছিল ইনাতাকে বলতে ইনাতা প্লিজ যেও না...
কিন্তু বলল না। কারণ সে জানে ইনাতাকে ভালোবাসি বলার কোন যোগ্যতাই তার নেই। ইনাতা রুপকথার রাজকন্যা। আর সে কিছুইনা। সবচেয়ে বড় কথা ইনাতা কষ্ট পাক এমন কিছুই সে করবেনা। আর কয়েকটা ঘন্টাই তো। তারপর সবশেষ। পরদিন গাড়িতে ওঠার আগে মুহিতের হাতে একটা প্যাকেট দিল ইনাতা এবং বলল সে যাওয়ার পরই খুলতে। যাওয়ার সময় ইনাতাকে খুব স্বাভাবিকই লাগছিল। নিজের চট্রগ্রাম দেখার ইচ্ছা পূর্ণ হওয়া এবং নিজের শহরে ফিরে যাওয়ার আনন্দও ছিল তার চেহারায়। ইনাতার কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার পর মুহিতের এই ভেবে একটু হালকা লাগছিল যে সে তার দ্বায়িত্ব ঠিকভাবে পালন করেছে। ইনাতা কষ্ট পাওয়ার মত কোন আচরন করেনি। এসব ভাবতে ভাবতে ইনাতার দেওয়া প্যাকেটটা খুলতে যেয়েও খুলল না। আলমারির এক কোনায় রেখে দিল আর মনে মনে ঠিক করল ইনাতা কে আর কোন মেইল করবেনা সে, কোন চিঠিরও উত্তর দিবেনা। প্রায় দশ দিন নিজের সাথে যুদ্ধ করে অবশেষে মুহিত হেরে গেল। সে বুঝতে পারলো একবার হলেও তার ইনাতাকে জানাতে হবে যে ইনাতা তার মনের কতটা জুড়ে আছে, ইনাতার যাওয়ার পর প্রত্যেকটা দিন প্রত্যেকটা মুহূর্ত সে কিভাবে কষ্ট পাচ্ছে। তাকে বলতেই হবে। কি আর বড়জোর ইনাতা তাকে লোভী ভাববে? বন্ধুত্ব নষ্ট হবে এইতো ? হোক তবু তাকে বলতেই হবে... এ ভাবনা মাথায় আসার পর মুহিত আর একমুহূর্ত দেরী না করে সাইবার ক্যাফেতে ছুটে গেলো। নিজের ইমেইল একাউন্টটি অন করার পরই দেখতে পেল ইনাতার তিনটি মেইল। প্রথমটি জার্মান পৌঁছানোর পর করা, দ্বিতীয়টিতে মুহিত কেমন আছে জানতে চেয়ে করা। এবং তৃতীয়টিতে একটি ছবি আর সাথে লিখা –
Muhit, there are few things we have to do what we don’t want from our heart may be this is called destiny. Anyway I m going to marry my friend Alex on 12th of March. Take care.
মুহিতের যা কিছু বলার ছিল ইনাতাকে সব ভুলে গেল সে । কাঁপা কাঁপা হাতে শুধু লিখলো – congratulations Inata.
Ogo bideshini, tumi onek onek valo theko …
মুহিত তখনো জানেনা তার আলমারির কোনায় পড়ে থাকা প্যাকেটটায় একটা নীল পাঞ্জাবি আছে। মুহিত কখনো জানবেনা এই পাঞ্জাবি কেনার আগে ইনাতা হোটেলের রিসেপশান এর মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করেছিল এদেশে মেয়েরা ভালোবাসার মানুষকে কেমন গিফট দেয়... মুহিত জানতেও পারেনি সেদিন সমুদ্র সৈকতে পায়ের আঙ্গুল দিয়ে বালিতে আচড় কাটার সময় ইনাতা ভীষণ করে চাচ্ছিল মুহিত একবার বলুক, ইনাতা তুমি যেওনা ...মুহিত বুঝতেই পারেনি ইনাতা চায়নি যেমনটা তার মায়ের সাথে হয়েছে তেমন মুহিতের সাথেও হোক। সে চায়নি মুহিত তার জন্য পরিবার হারাক। তাই বারবার বলতে যেয়েও বলতে পারেনি ভালোবাসি মুহিত...


1 comment: