এভাবেই থাকতে দাও.


 প্রেম সম্পর্কে যখন যা কিছু লেখা হয়েছে সব সত্যি বলেই জানতাম। শেক্সপিয়ারের কোন একটি লেখায় পড়েছিলাম, যে কোন ভ্রমণের পরিসমাপ্তি ঘটে প্রেমিক প্রেমিকার দেখা হবার মধ্য দিয়ে। এর পেছনে হয়তো কবির ধারণা ছিল এরপর থেকেই সত্যিকার অর্থে জীবন একদম বদলে যেতে শুরু করে। কি অসাধারণ একটি ধারণা,তাই না? ব্যক্তিগত ভাবে আমি এক্ষেত্রে মোটেও অভিজ্ঞ নই, কিন্তু বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে যে সে চমৎকার অভিজ্ঞতা শেক্সপিয়ারের হয়েছিল। একসময়, (অনিচ্ছা সত্ত্বেও) সম্ভবতঃ প্রেম নিয়ে একটু বেশীই ভাবতাম অন্য সবার চাইতে। যতটুকু একজন মানুষ সাধারণতঃ এ বিষয়ে ভাবে ,তার চাইতে খানিকটা বেশী। জীবনের এ পর্যায়ে এসে আজও আমি ক্রমাগত অবাক হই প্রেমের সে শক্তির দাপট রোমন্থনে যা কখনো নতুন করে মানবজীবনের সংজ্ঞা নিরুপণ করে দিত কিংবা কখনো এনে দিত আমূল পরিবর্তনের জোয়ার। শেক্সপিয়ার আরও বলেছেন ,প্রেম অন্ধ। আমি এ অভিব্যক্তির সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত। প্রেম অন্ধ বলেই আমরা হাজার দোষে ভরা ,অন্যায়ে জর্জরিত ভালবাসার মানুষটিকে শর্তহীনভাবে ভালোবেসেই যাই সে যত অপরাধ করে থাকুক না কেন। কিছু ধরা পড়লে,তাঁর জন্যে কৈফিয়ত বানাই, ভাবি দেখার ভুল বা হয়তো আমার বোঝার ভুল। এমন কিছুই সে করতে পারে বলে বিশ্বাস করতে চাই না। নিজের সঙ্গে নিজের লড়াইটা হেরে যাই যখন মুখে একটু হাসি লাগিয়ে সে এসে সামনে দাঁড়ায়...কি সহজেই আমরা সব কিছু ভুলে যাই প্রেমকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যে। কারও কারও জন্যে প্রেম,অব্যাকৃত ভাবে বিলীন হয়ে যায়;কারও জন্যে হয় বিবর্ণ,কারও জন্যে যায় পুরোপুরি হারিয়ে। অবশ্য সে প্রেম হয়তোবা কখনও ফিরেও পাওয়া যায়- একটি মুহূর্তের জন্যে হলেও। এরপর আবার আরেক ধরনের প্রেম আছেঃ সব চাইতে নিষ্ঠুরতম। যা কিনা তার শিকার কে প্রায় মেরেই ফেলে। তাঁর নাম প্রতিদানহীন ভালবাসা । আর এ ব্যাপারেই আমার রয়েছে এক বিশাল অভিজ্ঞতার ভান্ডার। প্রায় সব প্রেম কাহিনীতে আমরা এমন একটি গল্প পাই যেখানে মানুষ একজন আরেকজনের প্রেমে পড়ে। কিন্তু আমরা বাকীরা যারা গল্পের বাইরের মানুষ? আমাদের তাহলে কি গল্প, যারা একাই প্রেমে পড়ি? আমরা সেই একপেশে প্রেমের ভুক্তভোগী। আমরাই সেসব অভিশপ্ত প্রেমিকা । আবার আমরাই যে কারো সহানুভূতি আর ভালবাসার অনুপযুক্ত। চলমান জীবন্ত লাশ হিসেবেও আমাদের পরিচয় আছে। হ্যাঁ গো! আমি সে দলেরই একজন... জীবনের যে সময় থেকে প্রেম কি জেনেছি সে বয়স থেকে তারপরের ১৩টি বছর একজনকেই অন্তরের সবটুকু মায়ায় সাজিয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু আমি তার জন্যে যথেষ্ঠ ছিলাম না, বোধকরি তাই নতুনের খোঁজে আমাকে একাকি ফেলে চলে গেল। সুন্দরের পূঁজারী এ পৃথিবী, তাঁর আর কি দোষ দেব? এ জিনিসের যে আমার বরাবর-ই বড় অভাব! নিজেকে মূল্যহীন মনে করতে বাধ্য হলাম । বোধ করি আমার কোন যোগ্যতা নেই কারো মায়া পাবার,একটু সুন্দর কথা শুনতে পাবার কিংবা একটু খানি মায়ার দৃষ্টি পাবার। অযোগ্যতার অপমানের আগুলে জ্বলতে থাকি ! সে যে কি করুণ আর্তনাদের শব্দ সমস্ত প্রাণ জুড়ে! কিন্তু এতটা পুড়েও নিঃশেষ হয়নি জীবন...পোড়া এ জীবন থেমে যায়নি, বয়ে চলেছে অবিরাম...বুকের ভেতরের এমন সব অচেনা জায়গায় ব্যাথা করে যে গুলোর অস্তিত্ব আমারই ভেতরে ছিল, অথচ আজানা ছিল আজ অবধি। বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে অবিরাম আড্ডা,নতুন জায়গায় ঘোরাঘুরি কিংবা যত হাশি গানেই মেতে থাকতে চেয়েছি, সবই অর্থহীন হয়ে পড়তো ...রাতে ঘুমুতে যাবার সময় চোখের সামনে সবিস্তারে ভেসে ওঠে প্রতিটি মুহুর্ত, প্রতিটি ক্ষুদ্র ঘটনা। ভাবতে থাকতাম, আসলে বোঝার ভুলটা কোথায় ছিল? ক্ষণিকের জন্যে নিজেকে এতটা সুখি কিভাবে ভেবেছি, জানি না। নিজেকে বোঝাই, কোন একদিন সে হয়তোবা তাঁর ভুল বুঝতে পারবে, আর বোঝা মাত্রই আমার কাছে ছুটে চলে আসবে! দরজা খুলতেই দেখবো তার সে হাসি লাগা মুখখানি। কিন্তু হায়! বাস্তবে কি তাই হয়?... আহত বনের পশুর মত, শিকারী তীরে কাটা ক্ষতের যন্ত্রণায় কাতর হয়েও আরও একটি সূর্যোদয় দেখি। আজ এত বছর পরও আমার প্রতিটি রাত কাটে ঠিক এভাবেই । নতুন করে আবার শুরু করি এ প্রার্থনায় ,এ অসহনীয় অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে পারবো...কোন একদিন। নতুন কোন খানে গিয়ে দাঁড়াবো, দেখা হবে নতুন সব মানুষের সঙ্গে যাদের আন্তরিকতায় নিজেকে এতটা মূল্যহীন,তুচ্ছ মনে হবে না আর। এবং অবশেষে আমার ক্ষয়ে যাওয়া আত্নার ছোট্ট ছোট্ট অংশগুলো আমার মাঝে আবার ফিরে আসতে শুরু করবে একটু একটু করে...আর সীমাহীন কষ্টের আবছা হয়ে আসা সেইসব স্মৃতিগুলোর বিলুপ্তি ঘটবে-অপাত্রে নষ্ট হয়ে যাওয়া বছর গুলোর সঙ্গে সঙ্গে...ক্রমান্বয়ে হারিয়ে যাবে সময়ের ঘূর্ণিপাকে। প্রেমের জন্যে নতুন করে ব্যয় করার মত আমার এখন আর সে সময় বা ক্ষমতা নেই,নেই রুচি,নেই এতটুকু ইচ্ছে। এখনকার প্রেমিক-প্রেমিকারা আমার মত একজীবনে একজন ভালবাসার মানুষে বিশ্বাসী নয়। এখন বহুমুখি প্রেমের যুগ। এখানে আমি বড় সেকেলে। এগুলো দেখে শিউরে উঠি। একা আছি,ভালোই তো আছি ! আমি এভাবেই থাকতে চাই। দোহাই লাগে, আমাকে আমার মত থাকতে দাও!
লেখক--হানা আহমেদ 

0 comments:

Post a Comment