মেঘারণ্যে... এক ভালোবাসার গল্প !!

লেখক : ইফতেখারুল ইসলাম 

এক
মনে সুখ থাকলে নিজের জরাজীর্ণ বসতবাড়িটাও প্রাসাদতুল্য মনে হয়, আর ভ্রমণের সাধ জাগলে রেলের লক্কড়ঝক্কড় ট্রেনও উন্নত যান হিসেবে ধরা দেয়। এখানে যাত্রীদের বিনোদনের জন্যে কিছু না থাকলে কি হবে, পাশেই জানালাটা খোলা আছে- প্রকৃতি, পরিবেশ ও লোকালয়ভেদে সেখানে একের পর এক দৃশ্যপট পাল্টে যাচ্ছে। এখানে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা অপ্রতুল হলে কি হবে- কালিঝুলি মাখা কোচ ফ্যানগুলো তো ঘুরছে, হোক সেটা ঢিমেতালে।
অবশ্য দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর এই পদ্ধতি অধরা যতটা সহজভাবে মেনে নিয়েছে, নিবিড় ততটা নয়। বারবার প্রতীককে গালাগাল দিচ্ছে আর বলছে, "শালা, আর ট্রেন পাইলি না!"
প্রতীক ভেবে পায় না নিবিড়ের এত রাগ আসে কোত্থেকে। টিকেট করার সময় ট্রেন তো আর ডিসপ্লেতে থাকে না যে কোনটা কেমন চড়ে দেখে নিবে।
সুজানার আপাতত এসবে কোন মনোযোগ নেই। কানে ইয়ার-ফোন গুঁজে দিয়ে ও এখন নখে নেইল-পলিশ ছোঁয়ানোয় ব্যস্ত, যেন সহসাই কোন এক তরুণ এসে ওর হাত ধরে প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে বসবে, নখে নেইল পলিশ না দেখলে তরুণটি হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যাবে।
নিবিড় ভাবছে এই সুজানা আর প্রতীকের যন্ত্রণাই কি ওর জন্যে যথেষ্ট ছিল না, যে আবার উটকো ঝামেলা হিসেবে অধরা এসে জুড়ে বসেছে।
মেয়েটার এভাবে ওদের সাথে যুক্ত হওয়ার ব্যাপারটা নিবিড়ের কাছে এখনও এক রহস্য। গত কয়েকদিন কতভাবে বলা হয়েছে ওকে, রাজী হয়নি। অথচ আজ সকালে হুট করে ফোন দিয়ে জানাল যে ও যাচ্ছে।
এই রকম শেষ মুহূর্তে সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী মানুষ নিবিড়ের একদম পছন্দ নয়। ওদের আরেক ক্লাসমেট বাসা থেকে যাওয়ার অনুমতি পায়নি বলে, নইলে এই সময়ে এসে টিকেট ম্যানেজ হতো কোত্থেকে।
অধরা নিজেও অবশ্য কম রহস্যময় নয়। মেয়েটা এতদিন হয়ে গেল ওদের চেনে, অথচ এখনও পর্যন্ত কাউকে 'তুই' বলে সম্বোধন করেনি। সুজানাকে 'তুমি' আর অন্যদের 'আপনি'- এটা কিছু হলো!
ট্রেন চলছে অলস গতিতে।
নিবিড় ভাবছে ও পরবর্তী স্টেশনে নেমে যাবে কি না। এভাবে যাওয়ার কোন মানে হয় না। এমনিতেও এ ট্রিপের খরচটা অনেক কষ্টে ম্যানেজ করেছে ও- ক'টা দিন নিজের সকল যন্ত্রণা ভুলে থাকার জন্য। কিন্তু পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে না এ যাত্রা সুখকর হবে।
প্রতীকের ওপর ওর মেজাজ সপ্তমে চড়া। অথচ এ নিয়ে প্রতীকের কোন মাথা ব্যথা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। নির্বিঘ্নে বকবক করে যাচ্ছে ও। সুজানার কাছে জানতে চাইছে রেলভ্রমণের এমন একটা দিক সম্পর্কে যেটা বাসভ্রমণে নেই।
সারাদিন রূপচর্চা নিয়ে ব্যস্ত থাকা মেয়েদের জ্ঞানচর্চার পরিধি থাকে শিশুদের মতন। অনেক ভেবেচিন্তে ও বলল, "ট্রেন যাওয়ার সময় বাস সিগন্যালে দাঁড়িয়ে থাকে, যেমনটা আমি যাওয়ার সময় ছেলেরা থাকে।"
প্রতীক অবজ্ঞার স্বরে বলল, "বলেছে তোকে!"
"তা নয় তো কী?"
প্রতীক বলে, "বলব?"
সুজানা বলে, "ডেফিনিটলি!"
প্রতীক এবার একটা রহস্য তৈরি করে শেষটায় গিয়ে বলল, "আরে, ট্রেনে টয়লেট আছে, বাসে নেই।"
"এইটা কিছু হইল!"
ওদের কথা শুনে নিবিড়ের মনে হলো দুইটাকেই আবার স্কুলে ভর্তি করানো দরকার।
আবহটা ভালোই জমিয়েছিল প্রতীক। অধরাও ভাবছিল কী হতে পারে উত্তরটা। ও মনে করেছিল প্রতীক হয়ত বলবে ট্রেন ভ্রমণে এমন অনেক কিছুই উপভোগ করা যায় যেটা বাস ভ্রমণে সম্ভব নয়। যেমন ট্রেন যখন নির্জন পাহাড়ি পথ অতিক্রম করে তখন চারপাশের প্রকৃতি মনের গভীরে এমন এক অনুভূতি রেখে যায়, যা স্মৃতির বারান্দায় লতানো গুল্মের মতোই সজীব। তাছাড়া ট্রেনের নামগুলোও তো অদ্ভুত সুন্দর। ওরা যেটায় আছে সেটার নাম নীলাচল এক্সপ্রেস। যাত্রা শুরুর আগে অধরার খুব ইচ্ছে করছিল ট্রেনের দুই হাতল ধরে ঝুলে ছবি তোলার। কিন্তু ভেতরে ভেতরে এক ধরনের সঙ্কোচ কাজ করায় ও তখন কিছু বলতে পারেনি।
অধরার এটা প্রথম রেলভ্রমণ। প্রথম অভিজ্ঞতাতে খুব সাধারণ ব্যাপারগুলোও এক ভিন্নরকম আবেদন তৈরি করে। অধরা জানালা দিয়ে বাইরের রোদ ঝলমলে আকাশ দেখছে, কখনও রেলসেতুর নিচ দিয়ে বয়ে চলা নদী, কখনওবা বিস্তীর্ণ সবুজে চোখ বুলাচ্ছে। কামরার ভেতরের যাত্রীদেরও দেখছে এক-আধবার। সেই লোকটা যে ট্রেন ছাড়ার আগে সীট নাম্বার ভুল করে ওদের একটি আসনে গা এলিয়ে বসে ছিল, সে এখনও বিরক্তিভরা দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে- যেন ওরাই তার সীট দখল করে বসেছে। এক বৃদ্ধা কী নিয়ে যেন চেঁচামেচি করছেন- একটা বয়সে গেলে মানুষের মেজাজ হয়ত খুব খিটখিটে হয়ে যায়। ওপাশের জানালার ধারে বসা যাত্রীটি তার মুঠোফোনে কিছু একটা করছে, পাশের অপরিচিত যাত্রীটি হা করে দেখছে সেটা- অন্যের ব্যাপারে আমাদের আগ্রহের কমতি নেই। ছোট্ট মেয়েটি আদুরে গলায় বাবাকে ট্রেন নিয়ে নানান প্রশ্ন করছে- ওরও হয়ত এটা প্রথম রেলভ্রমণ।
সহসা সেই ছোট্ট মেয়েটির মাঝে অধরা নিজেকে কল্পনা করতে থাকে, আর তার বাবার জায়গায় ওর বাবাকে। মানুষ যে জীবন বাস্তবে যাপন করতে পারে না, সে জীবন হয়ত কল্পনায় যাপন করে। অধরা ভাবে, ছোট্ট মেয়েটি হয়ে ও যদি পারত বাবার সাথে এমন একটা ভ্রমণে বের হতে। মানুষ চাইলেই সব পারে, আবার অনেক কিছুই পারে না। সে চাইলেই পারে না অনেক ভালো লাগার মাঝে নিজের কষ্টগুলোকে বিলিয়ে দিতে। কষ্টগুলো চাপা যন্ত্রণা হয়ে ভেতরে ভেতরে গুমরে ওঠেই।
অধরা জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়। ট্রেন এখন একটা বাঁক নিয়েছে। জানালা দিয়ে পেছনের বগিগুলো দেখা যাচ্ছে। অধরার ইচ্ছে করছে পুরো ট্রেনটা একবার ঘুরে দেখার- একদম শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত। কিন্তু একা যেতে মোটেও মন চাইছে না। কাকে নিয়ে যাবে ও? প্রতীক ঘুমে ঢুলুঢুলু। সুজানা ফোন নিয়ে ব্যস্ত। ও কি নিবিড়কে বলবে?
নিবিড় কপাল কুঁচকে রাগী-রাগী একটা মুখ করে রেখেছে। এখন ওকে কিছু বলা ঠিক হবে না। যদি হুংকার দিয়ে উঠে!
অধরা চুপচাপ বসে থাকে।
দুই
স্টেশনজুড়ে মানুষের অস্থির আনাগোনা, ব্যস্ত ছুটে চলা। যে ব্যক্তিটি দুর্বল গলায় পাবলিক অ্যাড্রেস সিস্টেমে ট্রেনের খবরাখবর জানাচ্ছে তার সম্ভবত ভিটামিন ট্যাবলেট প্রয়োজন। কথা কিছুই বোঝা যাচ্ছে না।
ফয়সাল ঘড়ি দেখে। প্রতীক জানিয়েছিল দুপুরের মাঝে ওরা পৌঁছে যাবে। দুপুর গড়িয়ে গেছে অনেক আগেই, ওরা এখনও এসে পৌঁছায়নি। ও অপেক্ষা করতে থাকে। অন্য কোন সময় হলে এই মুহূর্তটা বিরক্তির কারণ হত। কারও জন্য অপেক্ষা করাটা খুব অপছন্দ করে ফয়সাল। অপেক্ষার সময়গুলো দীর্ঘ মনে হয় ওর কাছে, যেন এক একটি সেকেন্ড এক একটি ঘন্টা। কিন্তু এই সময়টা নস্টালজিয়ায় কেটে যাচ্ছে বেশ। স্মৃতিগুলো ভাবনার অলিগলি পেরিয়ে জড়ো হচ্ছে মনের চৌরাস্তায়।
কলেজ ছাড়ার কয় বছর পর আজ প্রতীকের সাথে দেখা হচ্ছে ওর? আড়াই বছর? নাকি আরও বেশি? সময় কীভাবে গড়িয়ে যায়! সেইযে বাবা মারা গেলেন। ফয়সালও পড়াশোনার পাঠ স্থগিত করে এখানে ওদের পারিবারিক ব্যবসায় মনোযোগ দিলো। তারপরের সময়গুলো যেন নিমেষেই হাওয়া!
তবে এক চিলতে অবসরে ফেলে আসা সেই দিনগুলো যে তাড়া করেনি ওকে তা নয়। কলেজের শেষ বর্ষে সামাদ স্যারের ঘুমপাড়ানি ক্লাসে ভাব বিনিময়ের এক ভিন্ন পন্থা আবিষ্কার করেছিল প্রতীক। বন্ধুদের মুঠোফোনে ক্ষুদে বার্তা পাঠাত ও, যাতে লেখা থাকত- চল, ক্লাস পালাই!
এবারও পালানোর ইচ্ছে পোষণ করেছে প্রতীক। তবে ক্লাস থেকে নয়, দৈনন্দিন জীবনের একঘেয়েমি থেকে। কয়েকটা দিন শহর থেকে দূরে ফয়সালদের বাংলো বাড়িতে থাকবে ওরা, আর বিচরণ করবে প্রকৃতির রাজ্যে।
ফয়সাল এসব ভাবছিল এমন সময় ওর মুঠোফোনটা বেজে উঠল। ক্ষুদে বার্তা এসেছে, যাতে লেখা- চল পালাই!
ফয়সাল ধরেই নিয়েছিল পেছনে তাকাতেই ও প্রতীককে দেখতে পাবে, কিন্তু দেখল এক তরুণীকে যে মুখের সামনে আয়না ধরে রেখেছে। ফয়সাল দেখার চেষ্টা করল মেয়েটি কে।
পাশ থেকে প্রতীক বলল, "কোন লাভ নেই দোস্ত। ও আয়না দেখার সব রেকর্ড ভাঙবে বলে পণ করেছে।"
সুজানা এবার মুখের সামনে থেকে আয়নাটা সরিয়ে বলল, "আর ট্রেনের গরমে আমার মুখে ব্রণ দেখা দিলে তোর হাড্ডি ভাঙ্গার রেকর্ডটা করব সবার আগে।"
সুজানার বলার ভঙ্গিতে কিছু একটা ছিল, প্রথম দেখাতেই ফয়সালের ওকে ভালো লেগে গেল। সিনেমা হলে এই সময় অবশ্যই একটা রোম্যান্টিক ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক বাজত। বাস্তবে সেরকম কিছু হয় না, তবে ভালো লাগার একটা আবেশ তৈরি হয়।
গাড়িতে সবার সাথে ফয়সালকে পরিচয় করিয়ে দিলো প্রতীক। ড্রাইভ করার ফাঁকে ফাঁকে প্রতীকের এই বন্ধুটি যে রেয়ার-ভিউ মিররে একটু পরপর ওকে লক্ষ্য করছিল, তা সুজানার চোখ এড়ালো না। সেই চাহনির অর্থ সুজানা স্পষ্ট করেই জানে। ও আর এসবের মাঝে জড়াতে চায় না।
গাড়ি একসময় শহুরে রাস্তা ছাড়িয়ে নির্জন পাহাড়ি পথ ধরে। দিনের শেষ আলোয় পাহাড়ের বুকে লোমের মতো জেগে উঠা অরণ্য আর তার উপর জমে থাকা মেঘ ভালো লাগার এক ভিন্ন অনুভূতি জাগায় সমতলের যান্ত্রিকতা আর ব্যস্ততার মাঝে বেড়ে উঠা একদল তারুণ্যের মাঝে। নিবিড়ের চোখেমুখেই শুধু যন্ত্রণার ছাপ, যেন ঘুরতে বের হয়নি ও- যুদ্ধ করতে বের হয়েছে। অবশ্য এখানে আসার ব্যাপারটা ওর কাছে যুদ্ধে যাওয়ার চেয়ে কম কঠিন ছিল না। সেঁজুতির সাথে ওর সম্পর্কের ব্যাপারটা নিয়ে ছোট চাচা আর ওদের পরিবারে এখনও ঝামেলা চলছে। সে ঝামেলা থেকে ওর পরিত্রাণ নেই। পারিবারিক জটিলতাগুলো কঠিন অসুখের মতো- একবার জেঁকে বসলে আর ছাড়ার নাম নেই।
ওরা যখন ডাকবাংলোয় পৌঁছাল তখন চারপাশে সন্ধ্যা নেমে এসেছে।
ফয়সালের বাবা বেশ শৌখিন মানুষ ছিলেন বলা যায়। পুরো বাংলো জুড়ে রঙ্গিন কাঠের ব্যবহারটা চোখে পড়ার মতো। বাংলোর সামনে ঘাসের গালিচা বেছানো লন। বাঁশের খোলে ঝোলানো মানিপ্ল্যান্টগুলো বারান্দার শোভা বাড়িয়েছে। বাংলোর নামটিও চমৎকার- ক্ষণিকালয়। তবে সবকিছু ছাপিয়ে যে ব্যাপারটি অনন্য তা হলো এর অন্দরের নিচু-নিচু আসবাবগুলো- চেয়ার, টেবিল, এমনকি খাটও। দেখামাত্র প্রতীক সেগুলোতে শুয়ে-বসে নানান ভঙ্গি করা শুরু করে দিলো আর ক্যামেরাটা ফয়সালের হাতে দিয়ে বলল সেগুলো ধারণ করতে।
এসব শিশুসুলভ আচরণ নিবিড়ের কাছে বাড়াবাড়ি মনে হয়। কাঁধ থেকে ব্যাগটা নামিয়ে ও চলে গেল ফ্রেশ হতে।
রাতের খাবার শেষে বসল জম্পেশ আড্ডা। পুরনো দুই বন্ধু যখন অনেকদিন পর আড্ডায় বসে তখন তাদের আলাপের বিষয়গুলোও ঘুরে-ফিরে সেই অতীত দিনগুলোতেই চলে যায়। তারা সেই দিনগুলোর স্মৃতি রোমান্থন করে আর বাকিরা সাবটাইটেল ছাড়া কোন ভিনদেশী ছবি দেখার মতো তা গিলতে থাকে।
নিবিড় অনেক আগেই সেখান থেকে উঠে চলে এসেছিল। ওর একটা নিরিবিলি জায়গা দরকার ছিল। সাদা কাগজে এখন নিজের সব কষ্টের কথাগুলো লিখবে ও। তারপর সেই কাগজটা টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে অনেক দূরে ফেলে দিবে। এতে কিছুটা হলেও হাল্কা লাগবে ওর।
নিবিড় একে একে লিখে যায় সেঁজুতির কথা, সেঁজুতিকে নিয়ে ওর ছোট্ট পৃথিবীর কথা আর ওদের সম্পর্ক ঘিরে পারিবারিক জটিলতার কথা। সহায়-সম্পত্তি নিয়ে ছোট চাচার সাথে বাবার আগে থেকেই একটা বিরোধ ছিল। সেঁজুতির সাথে ওর সম্পর্কের কথাটা জানাজানি হবার পর সে বিরোধ আরও প্রকট হলো। নিবিড় আর সেঁজুতি চেয়েছিল বিয়ে করে এসব ছেড়ে অনেক দূরে চলে যেতে। ছোট চাচা সেখানেও বাঁধা হয়ে দাঁড়ালেন। তারপর...
তারপর আর লিখতে ইচ্ছে করে না নিবিড়ের, নেশায় বুদ হতে চায় ও। সেঁজুতিকে কথা দিয়েছিল- আর কখনও নেশা করবে না। যাদের সঙ্গে থেকে এই নেশা করাটা শিখেছে তাদের সঙ্গও ছেড়ে দেবে। কিন্তু এখন কি আর সেই প্রতিজ্ঞাটা রাখতে পারবে ও?
নিবিড়ের সবকিছু অসহ্য লাগে। কাগজটা দুমড়েমুচড়ে বাইরে ফেলে দিয়ে বাথরুমে গিয়ে শাওয়ার ছেড়ে দেয় ও। শীতল জলের ধারা যদি মস্তিষ্কটাকে একটু শান্তি দিতে পারে।
নিবিড় কাগজটা ফেলার সময় খেয়াল করেনি যে অধরা সেখানে হাঁটছিল। ওর পায়ের কাছে সেটা এমনভাবে এসে পড়ে যেন ওকে উদ্দেশ্য করেই লেখা হয়েছে সেটা। কিংবা কে জানে, উপর থেকে কেউ হয়ত ইচ্ছে করেই এভাবে জোড়া লাগিয়ে দিচ্ছিলেন সবকিছু। অধরা না বুঝেই কাগজটা খুলে পড়তে শুরু করে।
তিন
শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ গা ভিজিয়েছিল বলেই কি না, নাকি সেঁজুতিকে হারানোর যন্ত্রণাটা ভেতরে ভেতরে আবার প্রকট হয়ে উঠেছিল বলেই- সে রাতে নিবিড়ের গা কাঁপুনি দিয়ে জ্বর এলো। সকালের দিকে জ্বর নেমে গেল বটে, কিন্তু জড়তা গেল না। এদিকে আজ সবার হিমপ্রপাত দেখতে বের হওয়ার কথা, কিন্তু নিবিড়কে রেখে ওরা যায় কি করে! এ নিয়ে কথাবার্তা চলছে এমন সময় নিবিড় কিছুটা রূঢ়ভাবেই বলল, "আমার জন্য কাউকে এত দরদ দেখাতে হবে না। যার যেখানে যাওয়ার ইচ্ছা সে যেতে পারে।" তারপরেও ওদের ভাবভঙ্গিতে একধরনের দ্বিধাদ্বন্দ্ব দেখা গেল। শেষমেশ অধরা থেকে গেল বাংলোতে।
গতরাতে নিবিড়ের সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো জানার পর থেকেই ওর জন্যে কেমন যেন একটা মায়া জন্মে গেছে অধরার মনে। ছেলেটা ইচ্ছে করে তো আর এমন খিটখিটে মেজাজের হয়ে যায়নি, পরিস্থিতি ওকে এমন করে তুলেছে। আর সেই পরিস্থিতিই হয়ত অধরাকে এমন চুপচাপ রহস্যময় করে দিয়েছে অন্যের কাছে। পারিপার্শ্বিকতা মানুষের ভেতরটা নিয়ন্ত্রণ করে খুব। আর আমরা কেবল বাহিরটা দেখি, ভেতরটা বোঝার চেষ্টা করি না একদম। যত্ন পেলে নিবিড়ও হয়ত এমন রূঢ় হতো না। অধরা জিজ্ঞেস করে, "নাস্তা দিব?"নিবিড় জবাব না দিয়ে মুখ ঘুরিয়ে শুয়ে থাকে।
অধরার থেকে যাওয়ার ব্যাপারটা নিবিড়ের কাছে বিরক্তিকর ঠেকে। অসুস্থতার সময় মানুষের মন বড্ড বেয়াড়া হয়ে যায়, নানা চিন্তায় মগ্ন হয় মস্তিষ্ক। দুশ্চিন্তা জীবনের যন্ত্রণাগুলোকে প্রবল করে তোলে বলে মানুষ অসহায়বোধ করে। তবুও কেন যেন সেসব নিয়েই থাকতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে সে। অধরার কারণে নিবিড়ের সে ভাবনায় ছেদ পড়ছে। একটু পরপর এসে খাওয়ার কথা জিজ্ঞেস করে জ্বালাতন করছে ও। বলছে, "রাত থেকে কিছু খাননি, শরীর দুর্বল হয়ে যাবে।"
শেষটায় নিবিড় না পেরে বলল, "দুর্বল হলে হোক, তাতে আপনার কি?"
অধরা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে চলে গেল।
ঘন্টা দেড়েক পর একটা প্লেটে করে গরম ধোঁয়া উঠা সাদা ভাত আর তার সাথে একটু ধনিয়াপাতা ভর্তা আর শুঁটকি ভুনা নিয়ে এলো ও। নিবিড় এবার বিস্মিত না হয়ে পারল না। জ্বরে মুখের রুচি একদম চলে গেছে, এমন কিছুই খেতে ইচ্ছে করছিল ওর।নিবিড় এবার থিতু হলো, জিজ্ঞেস করল, "এসব কে করেছে?"
অধরা বলল, "সেটা জানাটা জরুরী না। উঠে খেয়ে নিন, খাবার ঠাণ্ডা হয়ে যাবে।"
নিবিড় আগেও খেয়াল করেছে ব্যাপারটা। অধরা কখনও কখনও মনের কথা কীভাবে যেন বুঝে যায়। ও বলল, "আপনি কি টেলিপ্যাথি জানেন নাকি!"
"কেন?""নইলে জানলেন কী করে যে আমার শুঁটকি খেতে ইচ্ছে করছিল?"অধরা একটু ভেবে বলল, "কাউকে জানার জন্য টেলিপ্যাথি লাগে না। ভালো করে খেয়াল করলেই হয়।"
"কিন্তু কেউ কাউকে খেয়াল করে কখন, যখন তার প্রতি ভালোলাগা থাকে? আপনার কি আমার প্রতি কোনো ভালোলাগা আছে?" প্রশ্নটা করেই হঠাৎ চমকে গেল নিবিড়, এ কি জানতে চাইছে ও! যারা চুপচাপ ধরনের হয় তাদের পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা উন্নত থাকে, অধরার ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা হয়ত তেমন কিছু।
নিবিড় আর কথা না বাড়িয়ে ওয়াশ রুমে গেল ফ্রেশ হবার জন্যে। ফিরে এসে দেখল ওর অগোছালো বিছানাটা কে যেন গুছিয়ে দিয়ে গেছে, ওর মোবাইল মানিব্যাগসহ অন্যান্য টুকিটাকি জিনসগুলো এখানে-ওখানে পড়েছিল, এখন টেবিলে সাজিয়ে রাখা হয়েছে।
খাবার খেতে বসে নিবিড় ভাবে, অধরা কেন ওকে এতটা গুরুত্ব দিচ্ছে? এই পৃথিবীতে ও যে বড্ড গুরুত্বহীন! প্রতীকের ক্ষেত্রে যেমন ওর বাবা একটু পরপর ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করে- কোথায় আছিস, মা জানতে চায়- খেয়েছিস কি না, প্রেমিকা বলে- তোমাকে অনেক মিস করছি, ওর কথা জানার জন্য তো এভাবে কেউ ব্যাকুল হয় না। সেঁজুতি হতো, তাকেও হারিয়েছে ও।
অধরা কেন করছে এইসব, কেন ওকে বারবার সেঁজুতির কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে- যে আর কখনই ফিরে আসবে না ওর জীবনে।
হঠাৎ নিবিড়ের চোখ ছলছল করে ওঠে। ওর মনে হয় সেঁজুতি ওর পাশে বসে আছে। ওর মাথায় হাত রেখে চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে বলছে, "ছিঃ! কাঁদছ কেন নিবিড়? জানো না ছেলেদের কাঁদতে নেই।"
নিবিড় তাড়াতাড়ি চোখ মুছে।
ছেলেদের আবেগ প্রকাশ করতে নেই।
চার
ফয়সাল কি সম্মোহিত করতে পারে?সুজানা বারবার চিন্তা করে ওকে এড়িয়ে যাবে, ওর থেকে দূরে দূরে থাকবে। কিন্তু কোনটাই পারে না। ফয়সালের কথাবার্তা, বিনয়ী আচরণ সুজানাকে আরও দুর্বল করে দেয় ওর প্রতি। ছেলেটাকে একটু পরখ করে দেখা দরকার। মনে মনে সুজানাও চায় যাকে ও ভালোবাসবে সে বিশ্বস্ত হোক। সে শুধু সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে নয়, বরং হৃদয় দিয়ে ওকে ভালোবাসুক।
আর সেটা যাচাই করার জন্য আজ একদম সাদামাটাভাবে বের হয়েছে ও, মুখে কোন সজ্জার ছাপ নেই। যদিও সুজানার অবয়ব কৌতুকের সেই বিখ্যাত নারী চরিত্রটির মতো নয়, যাকে মেক-আপ ছাড়া অবস্থায় একদম চেনাই যায় না। তবে যেসব মেয়েরা সবসময় চোখে কাজলরেখা টানে, তাদের হঠাৎ একদিন চোখের সেই কালো রেখাটা ছাড়া দেখলে কেমন যেন অসুস্থ-অসুস্থ লাগে। সুজানার বেলায়ও তেমনটা মনে হচ্ছে। প্রতীক বিষয়টা খেয়াল করে মুচকি মুচকি হাসছে। সেই হাসির অর্থ সুজানার অজানা নয়। প্রতীক হয়ত ভেবে বসে আছে ওর মেয়েলি দিনগুলো চলছে। কিছু ছেলে মেয়েদের এই ব্যাপারটা নিয়ে ভেবে কি যে মজা পায়! মুচকি হাসির ছেলেগুলোকে সুজানার তাই চরম অপছন্দ। এই ছেলে কীভাবে নিম্মির সাথে সম্পর্ক চালিয়ে যাচ্ছে কে জানে!
প্রতীক সুজানার ভাবনার বিষয় না, ওর মনোযোগ ফয়সালের দিকে। যদিও ওর মুখটা এখন দেখতে পাচ্ছে না সুজানা। দেখা যাচ্ছে শরীরের একটা অংশ। গাড়ির টায়ার চেঞ্জ করছে ও। মুখটা দেখতে পারলে বোঝা যেত সুজানার ব্যাপারে আজ ওর আগ্রহের কোন কমতি আছে কি না। তাহলেই ব্যাপারটা স্পষ্ট হয়ে যেত সুজানার কাছে।
কিছু কিছু দিন থাকে যে দিনগুলোতে কোন কাজই পরিকল্পনামাফিক হয় না। আজ মনে হয় সেরকম একটা দিন। সকালে নিবিড়ের কারণে সবার বের হওয়ার ক্ষেত্রে একটা বাঁধা পড়ল, রওনা হওয়ার সময়েও গাড়ি স্টার্ট নিচ্ছিল না, আর এখন টায়ার পাংচার। এমন একটা জায়গা আশেপাশে কোনো গ্যারেজ আছে বলেও মনে হচ্ছে না। তবে ওরা গন্তব্যের কাছাকাছিই আছে। খুব কাছ থেকে জলপতনের শব্দ আসছে। শুধু জায়গাটা নির্দিষ্ট করা যাচ্ছে না। ফয়সাল টায়ার পাল্টানো শেষে পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া এক আদিবাসীকে জিজ্ঞেস করল হিমপ্রপাতটা কোনদিকে? আদিবাসীটি খুব আন্তরিকতার সাথে দিক নির্দেশনা দিতে লাগল।
ঢাকার রাস্তায় হলে এতক্ষণে পুরো কনফিউশনে পরে যেতে হত। কেউ বলত বামে, কেউ বলত ডানে। কেউ আবার উত্তর-দক্ষিণ-পূর্ব-পশ্চিম বলে হ-য-ব-র-ল অবস্থা করে ফেলত। তারা কি জানে না- এইজে নারেশন কম্পাস ছাড়া দিকের হিসাব বুঝে না? চিত্র ভিন্ন ঢাকা থেকে বের হলেই। তখন মানুষ কেবল পথ চিনিয়েই দিবে না, পারলে জায়গামতো নিয়েও যাবে।
আদিবাসীটির নির্দেশনামতো প্রপাত খুঁজে পেতে খুব একটা কষ্ট হলো না। তবে সেখানে গিয়ে কিছু বিব্রতকর অবস্থার মুখোমুখি হতে হলো। প্রপাতের প্রবেশ পথের অনেক স্থানেই লেখা- সুস্থ পরিবেশ বজায় রাখতে অসামাজিক কার্যকলাপ থেকে বিরত থাকুন, কিন্তু কার্যত তার প্রয়োগ দেখা গেল না। আড়ালে-আবডালে ছেলেরা মেয়েদের নিয়ে ম্যাসাজ পার্লার খুলে বসেছে। আর তা দেখার জন্য মানুষজনের কৌতূহলের শেষ নেই।
প্রতীকও চান্স মিস করতে চায় না। সুজানার মনে হচ্ছিল ঝর্ণার পানিতে প্রতীককে কয়েকবার গোসল করাতে পারলে ওর শান্তি লাগত। কিন্তু ওর কনসেন্ট্রেশন তো প্রতীক না, ফয়সাল। ফয়সালের মুখের কী অভিব্যক্তি? সুজানা জানে, ভেতরে ভেতরে সব ছেলেই এইসব অশ্লীলতা পছন্দ করে, বাইরে থেকে সে ছেলেটা যতই ভালোমানুষি বজায় রাখুক না কেন। ওর এক বান্ধবীর বড় ভাইও এমন ভালোমানুষি দেখাত, কিন্তু সুজানাকে একদিন নির্জনে পেয়ে কতটা অশ্লীলভাবেই না সে কথাবার্তা বলেছিল।
এদিকে ফয়সালের দিকে মনোযোগ দিতে গিয়ে সুজানা খেয়ালই করেনি কিছু বখাটে ছেলে যে ওকে আপাদমস্তক লক্ষ্য করছে। এদের দৃষ্টি ভালো ঠেকছে না। এরা যেকোন সময় কিছু একটা করে বসতে পারে।
সুজানা দেখল প্রতীক এতক্ষণে ঝর্ণার পানিতে নেমে গেছে। ফয়সালও নামার প্রস্তুতি নিচ্ছে। নিজেকে খুব অসহায় মনে হলো সুজানার। হঠাৎ সেই বখাটেদের অট্টহাসির আওয়াজ পাওয়া গেল। ওরা কি ওকে নিয়েই মন্তব্য করছে, কোন অশ্লীল ইঙ্গিত দিচ্ছে? সুজানা পেছনে ফিরে তাকানোর আগেই ফয়সাল ওর হাত ধরে ওকে সুরক্ষিত স্থানে নিয়ে এলো। সুজানা ভাবছে এই ছেলে করছে কী?
বখাটেদের হাত থেকে মুক্ত হয়ে ও আবার ভালো মানুষের মুখোশ পড়া কারো হাতে বলি হতে যাচ্ছে না তো!
জায়গাটা খানিক নিরিবিলি, ফয়সালের গায়ে কেবল স্যান্ডো গেঞ্জি আর থ্রি কোয়ার্টার। সেগুলো থেকে টপটপ করে পানি ঝরছে। সুজানা চোখ বন্ধ করে আড়ষ্টভাবে দাঁড়িয়ে আছে। ওর মনে হচ্ছে এখনই ওর নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাবে।
হঠাৎ ওকে অবাক করে দিয়ে ফয়সাল বলল, "আপনাকে এমন একটা জায়গায় নিয়ে আসাটা আমার ঠিক হয়নি। I'm Sorry!"
একথা শুনে সুজানা চোখ খুলে হা-করে তাকিয়ে রইল।
ফয়সাল আরও বলল, "কখনও কোনো মেয়েকে নিয়ে বের হওয়া হয়নি। আমার বোঝা উচিৎ ছিল আপনাকে এই জায়গায় নিয়ে আসাটা ঠিক হবে কি না।"
অপ্রত্যাশিত মুহূর্তে আমরা সাধারণত অপ্রস্তুত হয়ে যাই। সুজানাও হলো। কিছুক্ষণ ইতঃস্তত করে ও বলল, "আমরা কি এখন এখান থেকে বের হতে পারি?"
ফেরার পথে পুরোটা সময় সুজানা ভাবনায় আচ্ছন্ন হয়ে রইল। বের হয়েছিল ফয়সালকে পরীক্ষা করতে, কিন্তু নিজেই এখন পরীক্ষায় পরে গেল যেন।একটু আগে ঘটে যাওয়া পুরো ব্যাপারটা মনে করতে চেষ্টা করছে ও। তখন ভয় লাগছিল, এখন একটু একটু ভালো লাগছে।
ফয়সালকে এখন তো নির্ভর করা যায়, অন্তত এই ঘটনার পর?
সুজানা সাইড ভিউ মিররে ফয়সালের মুখখানা দেখতে চেষ্টা করে। প্রতিবিম্ব হলেও ফয়সালের অবয়বটা সেখানে পরম নির্ভরতার হয়ে ধরা দেয় সুজানার চোখে।
পাঁচ
কয়েকটা দিন কীভাবে যেন কেটে গেল।
সেদিন অধরাকে খুব মনমরা দেখাচ্ছিল।
আদিবাসী পল্লীতে গিয়ে সবাই অনেকটা সময় কাটাল, ওদের মার্কেট থেকে এটা-ওটা কিনল। অধরা কিছুই নিল না, এমনকি ছুঁয়েও দেখল না। অন্যমনস্ক হয়ে একপাশে দাঁড়িয়ে রইল।
নিবিড় মনে করতে চেষ্টা করল, এর মাঝে এমন কিছু হয়েছে কি না যাতে ও অভিমান করতে পারে। সেরকম কিছু মনে পড়ল না।
ফেরার পথে সুজানা ফয়সালের হাত থেকে ডিএসএলআর-টা নিয়ে নিজের ছবিগুলো দেখতে লাগল। বের হবার পর থেকেই ফটোসেশন শুরু করেছে ও। এ নিয়ে প্রতীক বলল, "হইছে, আর দেখা লাগবে না। ছবি তোলার সময় তোরে যা লাগছিল!"
সুজানা উৎসুক হয়ে জানতে চাইল, "একেবারে সুপার মডেলের মতো না?"
প্রতীক বলল, "হুম, সুপার মডেলের মতই। তবে যেভাবে হাত-পা আঁকাবাঁকা করে পোজ দিচ্ছিলি দেখে মনে হচ্ছিল আমাদের মডেল পোলিও রোগে আক্রান্ত!"
যথারীতি একটা হাসির আবহ তৈরি হলো। অধরাকেই শুধু দেখা গেল গোমড়ামুখে বসে থাকতে।
বাংলোয় পৌঁছুতেই অধরা নিজের রুমে চলে গেল। ক্লান্তি লাগছিল, তাই বিছানায় শরীর এলিয়ে দিতেই ঘুমিয়ে পড়ল ও।
বিকেলের দিকে যখন ওর ঘুম ভাঙল, রহস্যময় আলো-আঁধারিতে তখন রুমটা আচ্ছন্ন হয়ে আছে। অধরার ভয়-ভয় লাগছিল। চারপাশ এমন নীরব কেন? কেউ নেই মনে হচ্ছে।
অধরা লাইট জ্বালানোর জন্য সুইচ চাপল, কিন্তু লাইট জ্বলল না। ও আরও ঘাবড়ে গেল। এক পা- দু পা করে রুম থেকে বের হয়ে যেইনা বারান্দা পর্যন্ত গেল, ওমনি সবাই একসাথে বলে উঠলো, "হ্যাপি বার্থডে!"
প্রতীক পুডিংটা সামনে এগিয়ে দিয়ে বলল, "ইয়ে... অধরা... হয়েছে কি... এত অল্প সময়ের ভেতর আমরা কেক ম্যানেজ করতে পারিনি। পুডিং চলবে তো?"
সত্যিই, নিজের জন্মদিনের কথা বেমালুম ভুলে গিয়েছিল অধরা। ওরা জানল কী করে? অধরা নিবিড়ের দিকে তাকাল। নিবিড়ের হাসিহাসি মুখ বলে দিচ্ছে, সবাইকে ও-ই জানিয়েছে।শেষ কবে এভাবে বন্ধুদের নিয়ে জন্মদিন উদযাপন করেছিল ও? সেই যে একবার স্কুলে থাকতে। ওটাই প্রথম এবং শেষ ছিল। মা কত আয়োজন করেছিল সেইদিন, কত গেস্ট, কত সুন্দর করে সেজেছিল ও। বাবা এসে কি যেন একটা ব্যাপার নিয়ে মা'র সাথে রাগারাগি শুরু করলেন। বাবার মাঝে সেই সময় থেকেই একটা পরিবর্তন আসছিল। তার আচরণ ভীষণভাবে বদলে যাচ্ছিল। বাড়িতে আসা মানুষগুলোর সামনে মা কতটা ছোট হয়েছিল সেইদিন। তারপর থেকে বাসায় আর কোন আয়োজনই হয়নি।
ওর প্রতি বন্ধুদের ভালোবাসা দেখে অধরার চোখে পানি চলে এলো।
সুজানা বলল, "কি ব্যাপার, কাঁদছ কেন তুমি? পুডিং পছন্দ হয়নি?"
অধরা ছলছল চোখেই এক চিলতে হেসে দিলো।
সব আয়োজন শেষে অধরা যখন রুমে ঢুকতে যাবে, এমন সময় নিবিড় ওকে পিছে থেকে ডাক দিয়ে বলল, "আপনাকে কিছু দেখানোর ছিল।"অধরার চোখেমুখে প্রশ্ন- কী?"আমার সঙ্গে যেতে হবে।"
যেতে যেতে অধরা ভাবছিল কী হতে পারে ব্যাপারটা?
ছয় সহসা কোত্থেকে যেন একটি দলছুট মেঘ এসে অধরাকে ভেদ করে চলে গেল। ও বিশ্বাস করতে পারল না। যে জায়গাটায় ও আর নিবিড় এখন দাঁড়িয়ে আছে তার চারপাশে মেঘের সমুদ্র- অধরা চাইলেই ছুঁতে পারছে আকাশের মেঘ, যেই মেঘ ছোঁয়ার ইচ্ছে ওর বহুদিনের।নিবিড় বলল, "খুব সাধারণ মানুষ আমি, আজকের এই বিশেষ দিনে এর বেশিকিছু আমি দিতে পারব না।"একটি মেয়ে যখন একটি ছেলের অনুভূতি বুঝতে পারে তখন ছেলেটি ভালোবাসার স্পর্শ পায়, কিন্তু যখন একটি ছেলে একটি মেয়ের অনুভূতি বুঝতে পারে তখন মেয়েটি যেন তার সামনে পুরো পৃথিবী খুঁজে পায়।অধরা জিজ্ঞেস করে, "আপনি জানলেন কি করে মেঘ ছুঁয়ে দেখা আমার অনেক দিনের শখ?"নিবিড় বলল, "কারও ইচ্ছেগুলো জানার জন্য তার মনের গভীরে ঝাঁপ দিতে হয় না, শুধু একটু মনোযোগ দিলেই হয়।"দু'জনেই হেসে দিলো।অধরার সহসা মনে হলো, ও যদি নিবিড়কে কিছুক্ষণের জন্য জড়িয়ে ধরতে পারত। খুব কাঁদতে ইচ্ছে করছে ওর। ভালোলাগার মুহূর্তগুলোও অশ্রুসজল হয় কখনও কখনওরাতে ক্যাম্প-ফায়ারের ব্যবস্থা করা হলো। তার পাশে গিটার নিয়ে বসে পড়ল নিবিড়। ও যে গাইতেও পারে তা তো কারও জানা ছিল না!এক ফাঁকে প্রতীক অধরাকে বলল, "থ্যাঙ্কস অধরা, আমাদের এই বন্ধুটাকে আবার আমাদের মাঝে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য।"অধরা বলল, "মেনশন নট!"
সাত একটি নির্জন রাতের সঙ্গী হয় আকাশের চাঁদ। কিন্তু একজন নিঃসঙ্গ মানুষের- কেউ কি পারে তার শুন্যতা ঘোচাতে? পারে, হয়ত আরেকজন নিঃসঙ্গ মানুষ-ই।সেই রাতে অধরার ঘুম হয় না।
ও বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়।
এই যে এই সুন্দর দিনগুলো- কালকের পর আর থাকবে না এইসব। ও আবার ফিরে যাবে সেই বদ্ধ পৃথিবীতে, নাগরিক চার দেয়ালে, যেখানে ওর সময়গুলো বড্ড বৈচিত্র্যহীন।
অধরা আকাশের দিকে তাকায়। একটু আগেও সেখানে ভরা পূর্ণিমা ছিল, চাঁদের আলো মোমের মতো গলে গলে পড়ছিল আকাশজুড়ে। এখন সেখানে অসীম আঁধার, কালো মেঘের আড়ালে লুকানো চাঁদ।
জীবনের সুন্দর মুহূর্তগুলো কি এভাবেই হারিয়ে যায়... বিষণ্ণতার আড়ালে?
আট
স্টেশনে যাওয়ার জন্য সবাই প্রস্তুত, শুধু অধরার দেখা নেই।
সুজানা জানাল ও রেডি হচ্ছে। শুনে প্রতীক ফিক করে হেসে দিয়ে বলল, "এই কয়দিন তোর সাথে থাকতে থাকতে ওকেও কি তোর ভাইরাসে পেয়েছে নাকি, রেডি হতে এত সময় নিচ্ছে!"
সুজানা মুখ শক্ত করে প্রতীকের দিকে তাকিয়ে রইল।
কয়েক মুহূর্ত পরেই অধরা দৃশ্যমান হলো। ওর দেরি হবার কারণটা এতক্ষণে বোঝা গেল। গাঢ় নীল রঙের একটা শাড়ি পরেছে ও, তার সাথে মিলিয়ে কপালে টিপ, কানে দুল আর হাতে চুড়ি। সারাক্ষণ বেঁধে রাখা চুলগুলোও ছেড়ে দিয়েছে আজ। ভারী সুন্দর লাগছে ওকে, মনে হচ্ছে সবুজ প্রকৃতির মাঝে এক নীল অপরাজিতা।সবাই প্রস্তুত হয়। অধরা ধীরে ধীরে এগুয়। গাড়িটা এখন স্টার্ট না নিলেই হয়। কোন একটা বাঁধা আসুক, সবাই থেকে যাক এখানেই।
কিন্তু না, তেমন কিছুই হয় না, গাড়ি ঠিকই ছুটে চলে পাহাড়ি পথ পেছনে ফেলে। সহসা এল ঝলক হাওয়া এসে উড়িয়ে দিয়ে যায় অধরার খোলা চুল। এ হাওয়া বিদায়ী হাওয়া নয় তো?
সমাপ্তি
আবার সেই ট্রেন। আবার সেই মুখোমুখি বসা মানুষগুলো। এবার ফেরার পালা।
নিবিড়ের জন্য এ ভ্রমণটা স্মরণীয় হয়ে রইল। যাওয়ার সময় ভেবেছিল, এ যাত্রা সুখকর হবে না, অথচ কী অদ্ভুত- ফিরছে কিছু সুন্দর অনুভূতি নিয়ে।
সুজানার মন খারাপ। ফয়সাল যদিও কথা দিয়েছে সামনের মাসেই ও ঢাকায় যাবে, তবুও সুজানার কান্না পাচ্ছে। শুধু মেকআপ নষ্ট হয়ে যাওয়ার ভয়ে ও চোখের পানি ফেলতে পারছে না।
প্রতীক যথারীতি হাসি-তামাশায় মশগুল। পাশের সীটে বসা এক লোক এমন কড়া পারফিউম দিয়েছেন যে মনে হচ্ছে পুরো কামড়াজুড়ে এয়ার রিফ্রেশনার ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। তাই নিয়ে মজা করছে ও।
অধরা চুপচাপ। এসবের মধ্যে থেকেও সব থেকে বিচ্ছিন্ন। অন্য এক জগতে আছে ও। সে জগতে ফিরে না যাওয়ার তীব্র আকুতি।
নিবিড় কি পড়তে পারছে ওর মনের ভাষা, ও কি শুনতে পাচ্ছে ওর আকুতি? ও কি বুঝতে পারছে অধরা যা বোঝাতে চায়?
অধরার অস্থির লাগে, দম বন্ধ হয়ে আসতে চায়। ও সীট ছেড়ে বাইরে বের হয়ে আসে। একটা নিরিবিলি জায়গা খুঁজে বের করে। ট্রেনের খোলা দরজা দিয়ে বাইরে তাকায়।
এতক্ষণ বারবার মনে হচ্ছিল কোন একটা বাঁধা আসবে, নষ্ট ঘড়ির কাঁটার মতো সময়টা এখানেই স্থির হয়ে যাবে। কিন্তু সেরকম কিছুই হলো না।
সুন্দর করে সেজে নিবিড়ের হাত ধরে ও পাড়ি দিতে চেয়েছিল মহাকাল। তা আর হলো কই!অধরা দেখে একরাশ ধুলো উড়িয়ে ট্রেন দ্রুত ছুটে চলেছে গন্তব্যের দিকে। যা করার এখনই করতে হবে।অধরা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল।
আলতো করে কপালের টিপটা খুলল, তারপর সেটা ছুঁড়ে ফেলে দিল বাইরে, যতদূরে ফেলা যায়।
একইভাবে কানের দুল দুটো খুলল এবং ছুঁড়ে ফেলে দিল বাইরে, যতদূরে ফেলা যায়।
সবশেষে খুলল হাতের চুড়িগুলো। একে একে ফেলে দিল বাইরে, যতদূরে ফেলা যায়।
তারপর দরজার হাতল ধরে মুখসহ শরীরের অর্ধেকটা বাইরে ঝুলিয়ে দিয়ে যেইনা হাতদুটো ছেড়ে দিতে যাবে, এমন সময় পেছন থেকে কেউ একজন এসে ওর একটা হাত শক্ত করে চেপে ধরে। এক হেঁচকা টানে ভেতরে নিয়ে যায় ওকে।
অধরা মানুষটার দিকে তাকায়।
নিবিড় চেঁচিয়ে বলে, "কী করতে যাচ্ছিলেন এটা!"
অধরা এবার আর নিজেকে সংবরণ করতে পারে না। নিবিড়কে জড়িয়ে ধরে প্রথমবারের মতো 'তুমি' সম্বোধন করে কাঁদো-কাঁদো স্বরে বলে, "আমি আর ফিরে যেতে চাই না নিবিড়, আমি জীবনের এই সুন্দর দিনগুলোর মাঝেই বাঁচতে চাই। তুমি কি সময়টাকে এখানে স্থির করে দিতে পার?"
নিবিড় জবাব দিতে পারে না, এমন পরিস্থিতিতে একটি বিপর্যস্ত মেয়েকে কী বলে সান্ত্বনা দিতে হয় তা ওর জানা নেই।


0 comments:

Post a Comment