বাঙালির বংশ পদবীর ইতিহাস


বাঙালির বংশ পদবীর ইতিহাস খুব বেশি প্রাচীন নয়। মধ্যযুগে সামন্তবাদী সমাজ ব্যবস্থার ফলে পরবর্তীতে বৃটিশ আমলে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সমান্তরালে বাঙালির পদবীর বিকাশ ঘটেছে বলে মনে করা হয়। অধিকাংশ ব্যক্তি নামের শেষে একটি পদবী নামক পুচ্ছ যুক্ত হয়ে আছে। যেমন উপাধি, উপনাম কিংবা বংশসূচক নামকে সাধারণ ভাবে পদবী বলা হয়।

বাঙালির মূল নামের শেষে বংশ, পরিবার, পেশা, বসতিস্থান ইত্যাদির পরিচয়বাহী উপনাম ব্যবহারের রীতি প্রচলিত রয়েছে। সামন্ততান্ত্রিক পদবীর সঙ্গে জড়িয়ে আছে অনেক ক্ষেত্রেই জমি ও হিসাব সংক্রান্ত পদবী। তবে এই সমস্ত পদবীর বেশির ভাগই বংশ পরস্পরায় চলে আসলেও বর্তমানে পদবীর সমাজ গত মূল্য নেই বললেই চলে।

ইতিহাসের দিন বিচার করলে দেখা যাবে পদবী অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বাঙালি মুসলমানের পরিচয় ও মর্যাদাকে নিয়ন্ত্রণ করেছে। বাঙালি মুসলমান সমাজের বিকাশের প্রাথমিক দিনগুলিতে এই পদবী চেতনা জাত-ভেদ ও সামাজিক মূল্যকে নিয়ন্ত্রণ করতো। সুতরাং পদবী মাহাত্ম্য ও তার তাৎপর্যের আড়ালে লুকিয়ে রয়েছে জাত ও শ্রেণী চেতনা।

বাঙালি মুসলমান সমাজের একটা বড় সময় পার হয়েছে এই মনস্তাত্তিক দ্বন্দ্বে, যে দ্বন্দ্বে অঙ্গার হয়েছে বাঙালি হিন্দু সমাজ। তবে হিন্দু সমাজের মতো মুসলমান সমাজের মনস্তত্বে পদবীর কৌলীন্য বড় একটা প্রসার লাভ করতে পারেনি ইসলামের মৌলিক আদর্শের কারণেই, ইসলামে রক্ত ও বর্ণে সকল মানুষকে সমান মর্যাদা দান করা হয়েছে।

হিন্দু সমাজে কৃষ্ণ বর্ণের শুদ্রের পৌরহিত্যে পুজা সম্পন্ন না হতে পারলেও মুসলমান সমাজে শুদ্রের পরেও এমনকি অন্ত্যজের ইমামতিতেও নামাজ পড়তে বাধা নেই। সেদিক থেকে পদবী কৌলীন্যের স্বৈরতন্ত্র বাঙালি মুসলমান সমাজে শেকড় গেড়ে বসে মহীরুহ হয়ে উঠবার সুযোগ পায়নি।

শিশু কাল থেকেই একজন বাঙালি পদবীর স্পর্শে আপন জনের সমাদর লাভ করে বলে পদবী চেতনা সকলের মনে প্রাচীন একটা সংস্কারগত রীতির আভাস দেয়। মনে হয় যুগ যুগ তার বংশ গৌরব বা অগৌরব সবকিছুই বংশ পরম্পরায় পায়ে পায়ে এসেছে তার নিজের সময় পর্যন্ত।

অষ্টম শতকে বাংলাদেশে চরম নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলার পর গ্রাম সভা ও বিশিষ্ট নাগরিকরা সাধারণ একজনকে সম্রাট পদে বসিয়ে দিয়ে ছিলেন, যার নাম গোপাল’। কিন্তু এই গোপালের নামের শেষাংশ ধরে রাখবার প্রচেষ্টায় উত্তরাধিকাররা ক্রমান্নয়ে সকলেই নামের শেষে গোপাল এর পাল’ অংশকে পদবী হিসেবে ব্যবহার করতে থাকেন, পরে তাই ঐতিহাসিক পাল বংশের সূত্রপাত ঘটে।

আবার বল্লাল সেনের আমলে ছত্রিশটি জাত সৃষ্টি করে ছত্রিশটি আলাদা মর্যাদা তৈরি করা হয়েছিল। সমাজে এভাবে ছত্রিশটি প্রধান পদবীর ও সৃষ্টি হয় পেশাগত গুনের গুণে। এর পর ৩৬টি জাতে আরো শত রকম বিভাজন ঘটে এবং শত শত পদবীর সৃষ্টি হয় বাংলার সমাজে।

এই সব শত শত পদবীর উত্তরাধিকারত্ব লাভ করেছে ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকল বাঙালি বৌদ্ধ, বাঙালি হিন্দু এবং বাঙালি মুসলমান। চৌধুরী, তালুকদার, বিশ্বাস, মজুমদার, খান, মলি, মুন্সি, সরকার, সরদার প্রভৃতি প্রায় সকল পেশাগত সামাজিক পদবী রয়েছে হিন্দু, মুসলমান ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ে প্রায় সমানভাবে।

বাঙালি হিন্দু বা মুসলমান কিংবা খ্রিস্টান অথবা বৌদ্ধ সমাজে পদবী এসেছে বিচিত্রভাবে। ব্যক্তি বিশেষের নাম থেকে যেমন বংশ পদবীর ব্যবহার হয়েছে, তেমনি পদবী এসেছে বিভিন্ন পেশা থেকেও। শিক্ষক, সৈনিক, কারুশিল্পী, বণিক, রাজকর্মচারী, রাষ্টীয় উপাধি, গ্রাম অঞ্চল বাসী ইত্যাদি বিভিন্ন কারণে সামাজিক পদবীর সৃষ্টি হয়েছে এবং নির্বিচারে তার ব্যবহারও হয়েছে।

প্রাচীন যুগে অর্থাৎ হিন্দু আমলে এবং মধ্যযুগের মোঘল-পাঠান শাসনামলে ও আধুনিক কালের শাসনামলে পদবীসমূহ কম-বেশি সংস্কারকৃত হয়ে বাঙালি মুসলমান সমাজে প্রচলিত হয়েছে। তবে কিছু পদবী আছে, যা বাঙালি সমাজে শুধু হিন্দুশ্রয়ী, কিছূ পদবী একান্তই মুসলমানী, আবার বেশ কিছু পদবী হিন্দু – মুসলমান নির্বিশেষে সকল সম্প্রদায়ে নির্বিচারে ব্যবহৃত হয়।

শেখ, সৈয়দ, চৌধুরী প্রভৃতি বংশ পদবী বাঙালি মুসলমান সমাজকে আশরাফ এবং আতরাফ এই দুই শ্রেণীতে বিভক্ত করেছিল। একদা এই তথাকথিত আশরাফ সম্প্রদায় বাঙালি মুসলমান সমাজে শ্রেণী বৈষম্য সৃষ্টি করেছিলেন। এদেশের সাধারণ মুসলমানকে বলা হতো আতরাফ যার আভিধানিক অর্থ নিচু সমাজ, নিচু বংশ- নিচু বর্গের লোক। একথা বলতে দ্বিধা নেই যে, একমাত্র পদবী চেতনাই বাঙালি মুসলমান সমাজে সীমিত অর্থে হলেও একটা সময় সামাজিক শ্রেণী বৈষম্য সৃষ্টি করে রেখেছিল।


সেদিক থেকে বাংলাদেশের সামাজিক ইতিহাসের একটি দীর্ঘ কাল পূর্বে পদবীই নির্ধারণ করে বাঙালি মুসলমানের সামাজিক মর্যাদা। আর মজার ব্যাপার হলো অন্তত পদবীর পরিচিতিতে বাঙালি মুসলমান ও বাঙালি হিন্দু জাতি গত ঐতিহ্যের শিকড়কে খুঁজে পাওয়া যায়।

ধর্মগত বিভাগের খোলসের বাইরে বাঙালি হিন্দু ও বাঙালি মুসলমানের বংশগত ও পেশাগত ঐতিহ্যের গোড়ার কথা সন্ধান মেলে এই পদবী পরিচিতিতে। শেখ, সৈয়দ,মোগল, পাঠান, কাজী, গাজী, শাহ, মিঞা, মীর্জা, মোল্লা, খন্দকার, খানঁ ইত্যাদি কয়েকটি ভিনদেশী পদবী যা উপ মহাদেশে মুসলমান আগমনের সাথে জড়িত সে কয়টি পদবী বাদে বাংলার অধিকাংশ পদবীই হিন্দু-মুসলমান সম্প্রদায়ে বির্ধমান।

জমিদার শ্রেণীর উত্থান ঘটেছিল হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের নব্য ধনীদার থেকেই। কিছু জমিদারের প্রতীক পদবী চৌধুরী’ পরিচয় পাওয়া যায়। এমনকি বৌদ্ধ সম্প্রদায়েও চৌধুরী পদবীর ব্যবহার রয়েছে।


বাঙালির জমি- জমা বিষয় সংক্রান্ত আরো কিছু পদবী যেমন- হালদার, মজুমদার, তালুকদার, পোদ্দার, সরদার, প্রামাণিক, হাজরা, হাজারী, মন্ডল, মোড়ল, মল্লিক, সরকার, বিশ্বাস ইত্যাদি বংশ পদবীর রয়েছে হিন্দু -মুসলমান নির্বিশেষে সকল সম্প্রদায়ের একান্ত রূপ। দুই সম্প্রদায়েই এই একই পদবীর ব্যবহার অত্যন্ত তাৎপর্য পূর্ন।

বাঙালির সামাজিক ইতিহাসে এর ভূমিকা অসাধারণ ও প্রগতিবাহী,খাঁন বংশ পদবী যার আগমণ কিনা সুদূর আফগান পাঠান মূলুক থেকে, তা একান্তভাবে মুসলমানদের বংশ পদবী হলেও অনেক সমাজেও খাঁন’ পদবী একেবারে দূলর্ভ নয়। ঠাকুর বংশ পদবী একান্তভাবে হিন্দুর পদবী বলে মনে হলেও প্রচুর বনেষী মুসলমানের রয়েছে ঠাকুর পদবী।

বাঙালির হিন্দুর রয়েছে আলাদা ও স্বতন্ত্র পদবী যা একান্তভাবে তাদের অনেকটা গোত্রভূক্ত, বংশগত এবং কৌলিন্যের ও জাতিগত স্পর্শতা যুক্ত বলা চলে। বাঙ্গালির বর্ণ হিন্দু ব্রাক্ষণের জনপ্রিয় বংশ পদবী হচ্ছে বন্দ্যোপাধ্যায়, চট্টোপাধ্যায়, মুখোপাধ্যায়, গঙ্গোপাধ্যায় ইত্যাদি। এ গুলো কতকগুলি গ্রাম গোত্রের নাম থেকে উদ্ভুত। বন্দ্যঘটি গ্রামের কুলীন ব্রাহ্মণরা প্রথম ব্যচ শুরু করে ছিলেন বন্দ্যোপাধ্যায় পদবীর।

পরে তা আরো হরেক রকম ব্রাহ্মণের বংশপদবী হিসেবে ছড়িয়ে পড়ে। চাটুতি বা শুধু মাত্র চট্ট শব্দ থেকেই উৎপত্তি হয়েছে বাঙালির হিন্দু সমাজের চট্টোপাধ্যায় বংশ পদবীর। গাঙ্গুর বা গঙ্গ গ্রামের বসতি থেকে এসেছে গঙ্গোপাধ্যায় বংশ পদবী কিংবা মুকুটি বা মুখটি অঞ্চলের বসতিদের থেকে বিকশিত হয়েছে মুখোপাধ্যায় পদবী। বাদড়’ গ্রাম থেকে ভাদুড়ী বংশ পদবীর জন্ম হয়ে ছিল।

পাল পদবীকে ইতিহাসের দিক থেকে হিন্দু পদবীর বলা যায় না। কারণ প্রাচীন ইতিহাসের বৌদ্ধ পাল বংশের রাজাদের থেকে পাল বংশ পদবীর বিকাশ। এ ব্যাপারে ইতিহাসবিদগণ একমত হবেন যে, পাল রাজা গোপাল, রামপাল প্রমুখ থেকে পাল পদবী, পরে জাতিগত পদবী হিসেবে বিকশিত। তবে কুমার সম্প্রদায়ের লোকেরাও পাল পদবী ব্যবহার করে।

বাঙালি মুসলমানের শিক্ষক পেশার পদবী হলো-খন্দকার, আকন্দ, নিয়াজী ইত্যাদি। আর বাঙালি হিন্দুর শিক্ষক পদবী হচ্ছে দ্বিবেদী, ত্রিবেদী, চর্তুবেদী ইত্যাদি। টোলের কোন শিক্ষক বা উপধ্যায় কয়টি বেদ পড়েছেন তা থেকে শুরু হয়েছিল বিভিন্ন বেদী’ নামক বংশ পদবীর।

মুসলমানদের লোহানী’ পদবীর মতো হিন্দু সমাজের রয়েছে সাহানী পদবী। মনে করা হয় এই বংশ পদবী এসেছে সিন্ধু প্রদেশের সাহান অঞ্চল থেকে।

বাঙালি মুসলমানের যেমন প্রয়োজনের অতিরিক্ত আরবী-ইরানী প্রীতি রয়েছে, বাঙালি খ্রিস্টানেরও তেমনি রয়েছে ইংরেজ, পর্তুগীজ তথা পাশ্চাত্য প্রীতি। যেমন-বাঙালির মহাকবি মধুসূদন দত্ত হিন্দুত্ব ত্যাগ করে খ্রিস্টান হয়ে উনিশ শতকে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন।

কিন্তু এই মহান বাঙালিও বাঙালি চরিত্রের এতোটুকু স্খলন না ঘটিয়ে পিতৃ নামের আগে মাইকেল যোগ করেছিলন। দত্ত পদবী ত্যাগ করেননি তিনি, তবে দত্ত এর ইংরেজি উচ্চারন এর বাংলা উচ্চারণ করতেন ডাট বলে। ফলে খ্রিস্টান মধুসূদনের নাম দাঁড়ায় মাইকেল মধুসূদন ডাট’ বলে।

বাঙালি খ্রিস্টানের ইতিহাস চার শত বছরের প্রাচীন। বিদেশী খ্রিস্টান পুরোহিত বাংলাদেশে তাঁদের ধর্ম যাত্রা উপলক্ষে বাঙালিদেরকে খ্রিস্টান ভূক্ত করতে থাকেন। তাদের নাম অথবা সেই পুরোহিত যে অঞ্চলের থেকে আগত সেই অঞ্চলের নামানুসারে খ্রিস্টান ধর্মের নতুন ভাবে দীক্ষিত বাঙালি পদবীর সমাবেশ ঘটাতে থাকেন।

বাঙালি খ্রিস্টানের পদবীর মাহত্ম্য ও তাৎপর্য থেকে অনুধাবন করা যায়, যে সব পর্তুগীজ খ্রিস্টান ধর্মযাজক এদেশে এসেছিলেন, তাদের অধিকাংশই ছিলেন পর্তুগালের বিভিন্ন দ্বীপের অধিবাসী। সম্ভবত কোন ধর্মযাজক কতজন বাঙালিকে ধর্মান্তরিত করেছেন তা চিহ্নিত করার জন্যেই দেশান্তরিত নতুন বাঙালি খ্রিস্টানের নামের সাথে এই অঞ্চলের নাম বিশিষ্ট পদবী যুক্ত করা হতো।

বাঙালি খ্রিস্টানের ডি কষ্টা’ পদবী বলতে পর্তুগীজ ধর্মযাজক দ্বারা ধর্মান্তরিত খ্রিস্টান বুঝতে হবে। ডি রোজারিও’ পদবী মানে রোজারিও নামের দ্বীপ থেকে আগত ধর্ম যাজক দ্বারা খ্রিস্ট ধর্মে আলোকিত। ডি’মানে এখানে দ্বীপ’ বোঝানো হয়। গমেজ আর একটি বাঙালি খ্রিস্টানের বংশ পদবী। এর কোন তাৎপর্য পাওয়া যায় না। যেমন-বাঙালি বিশপ থিওটানিয়াস গমেজ।

প্রায় দেড় হাজার বছর পূর্ব থেকেই বাঙালি বৌদ্ধের প্রাচীন ইতিহাস খুব ভাল করেই পাওয়া যায়। বুদ্ধদেবের মতাবলম্বী প্রাচীন এই বাঙালি নাগরিকদের নাম ও পদবী পরিচিতির প্রধান দলিল হচ্ছে চর্যাপদ, বৌদ্ধ গান ও দোহা। যে প্রাচীন বাঙালি বৌদ্ধ দার্শানিক সমগ্র এশিয়া মহাদেশ মাতিয়ে ছিলেন সেই যুগে, তার নাম ছিল শ্রীজ্ঞান অতীশ দীপঙ্কর। এখানে কোনটি তার নাম, কোনটি খেতাব, কোনটি পদবী তা আবিস্কার করা সম্ভব নয়।

আবার কাহ্নপাদ ছিলেন সব চেয়ে বেশী চর্যার লেখক। তাঁর নামের সাথে পাদ’ শব্দ যুক্ত দেখা যায়। এই পাদ’ কি পদকর্তার খেতাব, নাকি এটি কোন পদবীই, সে বিষয়ে এখনো কোন গবেষক সিদ্ধান্তে আসতে পারেননি। বর্তমানে বাঙালি বৌদ্ধের জনপ্রিয় পদবী হচ্ছে বড়ুয়া’। বাংলাদেশের বসবাসকারী অধিকাংশ বৌদ্ধের নামের সাথেই বড়ুয়া’ পদবী যুক্ত দেখা যায়। বড়ুয়া অর্থ হচ্ছে সম্মানিত ব্যক্তি, আবার ধনী ব্যক্তিও। চট্টগ্রামের বৌদ্ধদের পদবী যেমন এটি, তেমনি আসামের কোন কোন অঞ্চলের হিন্দু ও মুসলমানের পদবীও রয়েছে বড়ুয়া’। বাঙালি বৌদ্ধের আরেকটি পদবী রয়েছে তা হলো মুৎসুদ্দী’। এর অর্থ প্রধান কেরানী অথবা প্রতিনিধিও হতে পারে। অনেক গবেষক মনে করেন মুৎসুদ্দী’ পদবীটি মধ্যসত্ত্বভোগী ব্যবসায়ী থেকে এসেছে। তাছাড়া বাঙালি বৌদ্ধদের মধ্যে দেওয়ান, চৌধুরী ইত্যাদি পদবীর ব্যবহার রয়েছে।


বাঙালির বংশ পদবীর ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা যায় উপরোক্তদের ছাড়াও কিছু ক্ষুদ্র জাতি সমূহের কিছু পদবী রয়েছে। যেমন-চাকমা, দেওয়ান, রায় ইত্যাদি। উপজাতি চাকমা ক্ষুদ্র জাতির প্রধান পদবী হচ্ছে চাকমা’। এছাড়া খীশা’ পদবীর ব্যবহারও দেখতে পাই। বাঙালি গারো, সাওতাল, হাজং প্রভৃতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতি গুলি মধ্যে প্রচলিত রয়েছে বিচিত্র রকমের বংশ পদবী। এর মধ্যে স্রং, সাংমা, রুরাম, দারিং গাগ্রা প্রভৃতি পদবীর ব্যবহার লক্ষনীয়।


পরিশেষে বাঙালির কিছু বিখ্যাত বংশ পদবীর ইতিহাস তুলে ধরতে চাই। এই যেমন-শিকদার, সৈয়দ, শেখ, মীর, মিঞা, মোল্লা, দাস, খন্দকার, আকন্দ, চৌধুরী, ভুইয়া, মজুমদার, তরফদার, তালুকদার, সরকার, মল্লিক, মন্ডল, পন্নী, ফকির, আনসারী, দত্ত ইত্যাদি।

শিকদারঃ সুলতানি আমলে কয়েকটি মহাল নিয়ে গঠিত ছিল এক একটি শিক। আরবি শিক হলো একটি খন্ড এলাকা বা বিভাগ। এর সাথে ফারসি দার যুক্ত হয়ে শিকদার বা সিকদার শব্দের উদ্ভব হয়েছে। এরা ছিলেন রাজস্ব আদায়কারী রাজকর্মচারী। শব্দকোষে যাকে বলা হয়েছে শান্তিরক্ষক কর্মচারী। এরা শিক বন্দুক বা ছড়ি বন্দুক ব্যবহার করতো বলে শিকদার উপাধী পেয়েছিল; সেই থেকে বংশ পরমপরায় শিকদার পদবীর বিকাশ ঘটে।


সৈয়দঃ সৈয়দ পদবী মূলত এসেছে নবী নন্দিনী হযরত ফাতেমা ও হযরত আলীর বংশ ধর থেকে। প্রায় দেড় হাজার বছর আগের এই বংশের সাথে কোনা যোগসূত্র না থাকলেও বাংলাদেশের অনেক মুসলমান পরিবার সৈয়দ বংশ পদবী ব্যবহার করে নিজেদের সম্ভ্রান্ত ও কুলীন মুসলমান বলে দাবি করে থাকেন। বাঙালি মুসলমান সমাজে সৈয়দ পদবীর অপব্যবহার ও পক্ষেপণ ঘটেছে সবচেয়ে বেশি। প্রকৃত পক্ষে সৈয়দ নন এবং পারিবারিক কোন কুলীন পদবীও নেই, অথবা পূর্ব পদবী ঐতিহ্য পরিত্যাগ করতে ইচ্ছুক এমন অনেক বংশ গোষ্ঠী বা ব্যক্তি বিশেষে বাংলাদেশে সৈয়দ পদবী আরোপিতভাবে ব্যবহার শুরু করেছিলেন।

শেখঃ শেখ আরবি থেকে আগত পদবী। সম্ভ্রান্ত মুসলমানদের সম্মানসূচক বংশ পদবী শেখ। যিনি সম্মানিত বৃদ্ধ অথবা যিনি গোত্র প্রধান, তাকেই বলা হতো শেখ। হযরত মোহাম্মদ (সঃ) সরাসরি যাকে বা যাঁদের ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করেছিলেন, তিনি বা তার বংশ ধরও শেখ নামে অভিষিক্ত হতেন অথবা শেখ পদবী লাভ করতেন। বাঙালি মুসলমান সমাজে যারা শেখ পদবী ধারণ করেন, তারা এ রকম ধারণা পোষণ করেন না যে, তারা বা তাদের পূর্ব পুরুষরা এসেছিলেন সৌদী আরব থেকে। বাঙালি সৈয়দ পদবী ধারীদের থেকে শেখ পদবীধারীদের এখানে একটা মৌলিক তাৎপর্যগত পার্থক্য রয়েছে। শেখ পদবী গ্রহণের নেপথ্যে রয়েছে ঐ পূর্বোক্ত চেতনা। নবীর হাতে মুসলমান না হলেও বাংলায় ইসলাম ধর্ম আর্বিভাবের সাথে সাথে যারা নতুন ধর্মকে গ্রহণ করে নেন; নও মুসলমান’ হিসেবে প্রাচীন ও মধ্যযুগে তারাই শেখ পদবী ধারণ করেছিলেন। পরবর্তীকালে তাদের বংশের উত্তর সূরীরাই শেখ পদবী ব্যবহার করে এসেছেন। এমনিতে অন্য ধর্মের লোকের কাছে মুসলমান মানেই শেখ বা সেক। কেউ কেই শেখ কেউ সেক কিংবা কেউ বা শেখ এর রূপান্তর শাইখও ব্যবহার করে থাকেন।


মীরঃ মির বা মীর শব্দটি এসেছে আরবি থেকে। আরবি শব্দ আমীর’ এর সংক্ষিপ্ত রূপ হচ্ছে মীর। সেই অর্থে মীর অর্থ দলপতি বা নেতা, প্রধান ব্যক্তি, সরদার ইত্যাদি। জিতে নেয়া বা জয়ী হওয়া অর্থে মীর শব্দের ব্যবহার হতো। তবে মীর বংশীয় লোককে সম্ভ্রান্ত এবং সৈয়দ বংশীয় পদবীধারীর একটি শাখা বলে গাবেষকরা মনে করেন।


মিঞাঃ মিঞা মুসলিম উচ্চ পদস্থ সামাজিক ব্যক্তিকে সম্বোধন করার জন্য ব্যবহৃত সম্ভ্রম সূচক শব্দ। এক অর্থে সকল মুসলমানের পদবীই হচ্ছে মিঞা। বাঙালি হিন্দুর মহাশয়’ এর পরিবর্তে বাঙালি মুসলমান মিয়া শব্দ ব্যবহার করে থাকে। মিঞা’ শব্দটি এসেছে ফারসি ভাষা থেকে। প্রভু বা প্রধান ব্যক্তি বুঝাতেও মিয়া শব্দের প্রয়োগ করা হয়ে থাকে। তবে গ্রামীন প্রধান বা সর্দার অর্থের মিঞা পদবী হিসেবে বাঙালি মুসলমান সমাজে ঠাঁই পেয়েছে।


মোল্লাঃ মোল্লা এবং মুন্সী বাঙালির দুটো জনপ্রিয় পদবী। তাদের প্রসার প্রায় দেশব্যাপী। বঙ্গীয় শব্দকোষ এ মোল্লা শব্দের অর্থ করা হয়েছে মুসলমান পুরোহিত। বস্তুত এভাবে মসজিদে নামাজ পরিচালনার কারনেও অনেকে মোল্লা উপাধি পেয়েছিল। প্রকৃত পক্ষে, মোল্লা হচ্ছে তুর্কি ও আরবি ভাষার মোল্লা থেকে আগত একটি শব্দ যার আভিধানিক অর্থ হচ্ছে পরিপূর্ণ জ্ঞান বিশিষ্ট মহাপন্ডিত ব্যক্তি। অন্য অর্থে মুসলিম পন্ডিত বা ব্যবস্থাপক বা অধ্যাপক হলেন মোল্লা। পরবর্তী কালে মসজিদে নামাজ পরিচারলনাকারী মাত্রই মোল্লা নামে অভিহিত হতে থাকে। এখান থেকেই সাধারণত বংশ পদবী হিসেবে তা ব্যবস্থার হওয়া শুরু হয়। তাঁরা সকল জ্ঞানের জ্ঞানী না হওয়া সত্ত্বেও মোল্লা পদবী ধারণ করে। যার ফলে মোল্লার দৌড় মসজিদ পর্যন্ত’ প্রবাদের উৎপত্তি হয়েছে।


দাসঃ বাঙালি হিন্দু সমাজে দাস বা দাশ বংশ পদবীর ব্যাপক ব্যবহার রয়েছে। যে সমস্ত হিন্দু সম্পদায়ের মানুষ পদবীতে দাশ লিখেন তাদের পেশা ধীবর থেকে এসেছে বলে গবেষকরা মনে করেন। আর যারা দাস লেখেন তাদের পদবী স্রষ্টার ভূত্য চেতনা থেকে এসেছেন।

খন্দকারঃ মুসলিম সমাজের ফারসি শিক্ষক হিসেবে খোন্দকার বা খন্দকারের পরিচয় পাওয়া যায় । অন্য দিকে খোন্দকারের ‘ পদবী এসেছে সামন্ত সমাজ থেকে পেশাজীবী হিসেবে। সাধারণ ভাবে খোন্দকার বা খন্দকার অর্থ হচ্ছে কৃষক বা চাষাবাদকারী । মনে করা হয় ফারসি কনদহ ‘ এর যার অর্থ কৃষি’সাথেকার যুক্ত হয়ে কনদহকার> খনদহকার>খন্দকার হয়েছে। ভিন্ন মতে, খন্দকারের মূল উৎপত্তি সংস্কৃত কন্দ> খন্দ যার অর্থ ফসল বলা হয়েছে। এই খন্দ এর সাথে কার যুক্ত হয়েও খন্দকার> খোন্দকার হতে পারে। এবং এতেও পূর্বের খন্দকার’ শব্দের উৎসের অর্থের তারতম্য ঘটছে না। আবার ফারসি ভাষায়, খোন্দকার বলে একটি শব্দ আছে যার অর্থ শিক্ষক। সেখান থেকেও খোন্দকার পদবী আসা বিচিত্র কিছু নয়। অথবা খোন্দকার শব্দের যে ভিন্নভিন্ন অর্থ তার সবগুলো মিলিত তাৎপর্য থেকেই বিভিন্নভাবে খন্দকার পদবীর উৎপত্তি হয়েছে।

আখন্দঃ খন্দকার ও আখন্দ বা আকন সমার্থক। আখন্দ ও আকন নামে যে সব পদবী তাও সম্ভবত খন্দকার পদবীরই রূপভেদ। খন্দকার>আখন্দ> আকন হয়ে থাকতে পারে। আবার ফারসি আখুন্দ থেকেও আখন্দ এসে থাকতে পারে। যার অর্থ শিক্ষক। তবে আকন্দ এসেছে আখন্দ থেকেই।


চৌধুরীঃ সংস্কৃত চতুধারী শব্দ থেকে এসেছে বাংলা চৌধুরী শব্দ। এর অর্থ চর্তুসীমানার অন্তগর্ত অঞ্চলের শাসক। বাংলাদেশের বেশির ভাগ জমিদারদের পদবী হচ্ছে চৌধুরী।


আবার অনেকে মনে করেন চৌথহারী’ যার অর্থ এক চতুথাংশ রাজস্ব আদায়কারী, সেখান থেকে উচ্চারণ পরিবর্তনের মাধ্যমে এসেছে চৌধুরী’। সেদিক থেকে চৌথ আদায়কারী বা রাজস্ব আদায়কারী পদ সৃষ্টি হয়েছিল বাংলার রাষ্ট্র ব্যবস্থার। বঙ্গীয় শব্দকোষ বলছে,চতুর’ যার অর্থ তাকিয়া বা মসনদ, তার সাথে যুক্ত হয়েছে ধর’ (অর্থ ধারক) এবং এই দুয়ে মিলে হয়েছে চৌধরী’ > আর তার থেকেই চৌধুরী’। তবে তা মূলত হিন্দী ও মারাঠি শব্দ। জাতি ধর্ম নির্বিশেষে চৌধুরী বংশ পদবী ব্যবহার করা হয় এদেশে। বৃটিশ-ভারতের প্রায় সর্বত্র এ পদবীর অস্তিত্ব ছিল। কারণ চৌধুরী ছিল সামন্ত রাজার পদবী।


ভূঁইয়াঃ এই বংশ পদবীটি এসেছে খোদ ভূমির মালিকানা অর্থ থেকে। বাঙালি হিন্দু-মুসলিম উভয় এর মধ্যে এ পদবীর প্রচলন আছে। বাঙালি হিন্দু সমাজে যাঁরাই ভৌমিক’ বাঙালি মুসলমান সমাজে তারা ভূঁইয়া’ হিসেবে পদবী ধারণ করেছেন। মূল সংস্কৃত শব্দ ভৌমিক > (প্রাকৃত) ভূমিকা > (বাংলা) ভূঁইয়া > থেকে ভূঁইয়া বা ভূঁঞা এসেছে। প্রাচীন বড় জমিদার বা সামন্ত রাজার উপাধিও ছিল ভূঁইয়া। প্রকৃত পক্ষে কুলীন বংশ পদবীই ছিল তা। আবার যে সব মানুষ আগে স্থান বিশেষে বনজঙ্গল পরিষ্কার করে বসতি ও চাষাবাদের পত্তন করেছে তারা স্থানীয় জমিদার রাজার কাছ থেকে ভূঁইয়া নামে অভিহিত হয়ে ঐসব জমি জমার স্বত্ব লাভ করেছে।


মজুমদারঃ মজুমদার’ পদবী মূল আসলে মজুনদার’। এর মূল ফারসি শব্দ হচ্ছে মজমু আনদার’। রাষ্ট্রের ও জমিদারির দলিল পত্রাদির রক্ষক রাজকর্মচারীর জন্যে এই পদবী সংরক্ষিত ছিল। হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সমগ্র বাংলাদেশে মজুমদার’ পদবীর ব্যবহার লক্ষনীয়।

তরফদারঃ আরবি তরফ’ এবং ফারসি দার’ মিলে তরফদার শব্দের সৃষ্টি। রাজ্যের খাজনা আদায়ের মহালে তদারককারী বা খাজনা
আদায়কারীর উপাধী ছিল তরফদার। এই পদবী ব্যবহারকারী গোষ্ঠীর পূর্ব পুরুষরা রাজকার্য পরিচালনার কাজে নিয়োজিত ছিলেন,
সেখান থেকেই এই বংশ পদবী উৎপত্তি ও প্রচলন। অন্যমতে তরফদার তরফের রাজস্ব আদায়কারী লোক; তরফের মালিক; পদবী বিশেষ।

তালুকদারঃ আমাদের দেশে পরিচিত একটি বংশ পদবী। বাংলাদেশে জমিদারির পরই তালুক ভূ-সামাপত্তির একটি বিভাগ। মোগল ও বৃটিশ আমলে রাজস্ব ও ভুমি সংক্রান্ত বিষয়াদি থেকে যে সমস্ত পদবীর উৎপত্তি ও বিস্তার তার মধ্যে তালুকদার’ হচ্ছে অন্যতম পদবী। তালুক’ শব্দ থেকেও এই পদবীর মর্মাথ উপলব্ধি করা সম্ভব। আরবি শব্দ তা’ আল্লুক’ যার অর্থ ভূ-সম্পত্তি এবং এর সাথে ফারসি দার’ যুক্ত হয়ে (তা’আল্লুক+দার) তালুকদার’ শব্দের উৎপত্তি হয়েছে। প্রকৃত পক্ষে, যিনি তালুকদার, তিনি জমি ও ক্ষুদ্র ভূ-সম্পত্তি বন্দোবস্ত নিতেন সরকারের কাছ থেকেও যেমন, তেমনি জমিদারের কাছে থেকেও। ফলে তিনি হতেন উপজমিদার সেই অর্থেই এসেছে তালুকদার’।


সরকারঃ সরকার’ শব্দটি ফারসি থেকে আগত। এর অর্থ প্রভূ, মালিক, ভূস্বামী, শাসনকর্তা, রাজা। অর্থ আদায় ও ব্যয় সংক্রান্ত কর্মচারি ও সরকার। মোগল আমলে এদেশের স্থানীয় রাজকর্মচারিদের এ পদবী দেয়া হতো। মোট কথা প্রধান কর্মচারি এবং সম্পত্তি দেখাশুনার কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিকে সরকার বলা হতো। বাঙালি হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যেই এ পদবীর ব্যবহার আছে।
মল্লিকঃ আরবি মালিক’ বা মলিক’ শব্দ থেকে এসেছে মল্লিক’ বংশ পদবী। ফারসি মালিক শব্দজাত মল্লিক ভূম্যাধিকারী বা জোতদারের উপাধি। গ্রাম প্রধান বা সমাজের প্রধান ব্যক্তি মালিক। আবার লিপিকুশল রাজকর্মচারিকে মোগল আমলে মল্লিক বা সুলেখক আখ্যা দেয়া হত বলেও আমরা জানতে পারি। হয়তোবা সেই থেকে মল্লিক বংশ পদবী এসেছে।


মন্ডলঃ বাঙালি হিন্দু-মুসলিম সমাজে সমান ভাবে ব্যবহৃত হয় মন্ডল পদবী। বাংলাদেশে অতীত কাল থেকে গ্রামের অনানুষ্ঠানিক এবং সাধারণ ভাবে গ্রাম- প্রধানকে বলা হয় মন্ডল। বাংলা মন্ডলরা আগে অত্যন্ত প্রভাবশালী ব্যক্তি ছিলেন। মন্ডলীয় কাজ করে তারা অনেক অধিকার ভোগ করতেন। খাজনা আদায়কারী ও রায়তদের মধ্যস্থতা করা কিংবা গ্রামীন বিবাদ আপোস মীমাংসা করতে মন্ডলরা কার্যকরী ভূমিকা পালন করতেন। কোন কোন সময় তাদের অধীনে পাটোয়ারি, তহসিলদার, চৌকিদার ইত্যাদি কর্মচারী কাজ করতেন। সরকার ও রায়তদের মধ্যবর্তী মানুুষ হিসেবে মন্ডলরা অধিক পরিচিত ছিল।


ফকিরঃ মুসলমানদের মধ্যে সন্ন্যাসবৃত্তি’ থেকেই এসেছে ফকির’ পদবী। মরমী সাধকরা গ্রহণ করতেন ফকির’ পদবী। এটি আরবি শব্দ, যার মূল অর্থ নি:স্ব। আবার আরবি ফকর শব্দের অর্থ দারিদ্র। এ থেকে ফকির শব্দের উৎপত্তি। ফকির এবং পার্শি দরবেশ ব্যক্তিগণ সাধারণত এদেশে ফকির নামে পরিচিত। বিশেষ কোন ধর্ম মতের একান্ত অনুসারী না হয়ে যারা সকল ধর্মের মূলনীতি নিয়ে আত্মতত্ত্বের সন্ধান করেন তাদেরকেও ফকির বলা হয়। আবার সুফি বা বাউল তত্বের ধারকরাও ফকির।


ঠাকুরঃ বাংলা শব্দের বিশেষজ্ঞ হরিচরণ বন্দ্যোপধ্যায়ের মতে- ঠাকুর শব্দের মূল হচ্ছে (সংস্কৃত) ঠাক্কুর’ তার থেকে > (প্রকৃত) ঠকুর > (বাংলা) ঠাকুর এসেছে। পদবীগত দিক থেকে তা ব্রাক্ষণের পদবী বিশেষ, এমনকি ক্ষত্রিয়েরও উপাধি এটি। মধ্য যুগের কাব্য চৈতন্য ভাগবত’ উদ্ধৃত করে লেখক বলেছেন, তা বৈঞ্চবেরও উপাধি। যেমন, হরিদাস ঠাকুর। পাচক ব্রাক্ষণও এক প্রকার ঠাকুর বলে পরিচিত। তবে আহমদ শরীফ সম্পাদিত সংক্ষিপ্ত বাংলা অভিধান’ বলছে, সংস্কৃত ঠক্কুর থেকে ঠাকুর আসলেও এর মূলে ছিল তুর্কী শব্দ। বাঙালি হিন্দু-মুসলমান উভয়েই এই পদবী ব্যবহার করে।

এরকম শতাধিক বংশ পদবী রয়েছে আমাদের দেশে। সব বংশ পদবীর ইতিহাস লিখলে বিশাল আকৃতির বই হবে। আমি আর সে দিকে যেতে চাইনা। পরিশেষে বলতে চাই বাঙালির পদবীর ইতিহাস বৈচিত্র পথ ও মতের এক অসাধারণ স্মারক হিসেবে চিহিৃত। (তথ্য সুত্র : নানা পুস্তক)f




দেশ দেখে বেড়ানোটা আনন্দের। কিন্তু সেটা যদি হয় আর্থিক সঙ্গতির মধ্যে, তবেই তা সম্ভব। বিভিন্ন মানুষের দেশ দেখে বেড়ানো বিভিন্ন রকম। বিলাসবহুল জীবনযাপন যারা করেন তারা একটু আভিজাত্যের ছাপ রেখেই দেশ-বিদেশ ভ্রমণ করে বেড়ান। কিন্তু সবার সঙ্গতি তো আর সমান নয়। আর সমান নয় বলেই কি দেশ-বিদেশ ভ্রমণ করা যাবে না?
যাবে। অবশ্যই যাবে। চারদিক থেকে নিজের আভিজাত্যকে একটু কাটছাঁট করে নিলেই তা সম্ভব। স্বল্প খরচে, অল্প আরামে মনটাকে মানিয়ে নিতে পারলেই আমাদের চোখের সামনে খুলে যাবে সৃষ্টির অনেক অজানা দুয়ার। আর সেই দুয়ার খুলেই চলুন চট করে বেড়িয়ে আসা যাক, হিমালয়ের কোল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা ছবির মতো সুন্দর স্বপ্নপুরী দার্জিলিং থেকে।
darjeeling
কিভাবে যাবেন?
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে বিভোর নগরী পাহাড়ে ঘেরা অপূর্ব চিরহরিৎ ভূমির দার্জিলিংয়ে স্থলপথে রাজধানী ঢাকা থেকে সরাসরি দার্জিলিং যেতে চাইলে উত্তরবঙ্গের বুড়িমারি সীমান্ত অতিক্রম করে যাওয়াটাই সবচেয়ে সুবিধাজনক। ঢাকার গাবতলী থেকে প্রতিদিন অসংখ্য যাত্রীবাহী বাস চলাচল করে উত্তরবঙ্গের বুড়িমারী সীমান্তের উদ্দেশে। ঢাকার ভারতীয় দূতাবাস থেকে পাসপোর্টে নির্দিষ্ট সময়ের ভিসা নিয়ে রাত ১০টার সুপার সেলুন চেয়ার কোচে উঠে পড়–ন বুড়িমারী সীমান্তের উদ্দেশে। ভাড়া জনপ্রতি আর কত সামর্থের মধ্যেই।
ভোর ৭টা নাগাদ আপনি অনায়াসে পৌঁছে যাবেন বুড়িমারী চেকপোস্টে। ইমিগ্রেশন অফিসের কাছেই সব বাস থামে। প্রাতঃরাশ সম্পন্ন করে ইমিগ্রেশনের দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তির সঙ্গে সম্পন্ন করে নিন ভ্রমণ কর ও কাস্টমসের সব প্রক্রিয়া। অবশ্য আপনি চাইলে ঢাকা থেকেই ভ্রমণ কর প্রদান করে যেতে পারেন সোনালী ব্যাংকের যে কোন শাখায়। বুড়িমারী অতিক্রম করে ওপারে চ্যাংড়াবান্দা সীমান্তে পৌঁছে একইভাবে সম্পন্ন করে নিন আপনার ইমিগ্রেশন ও কাস্টমসের সব প্রক্রিয়া। ও ভালো কথা, আপনার বহনকৃত ইউএস ডলার চ্যাংড়াবান্দায় অবস্থিত সরকার অনুমোদিত ডিলারদের কাছ থেকেই ভারতীয় মুদ্রায় পরিবর্তন করে নেবেন। অন্যথায় পরবর্তী সময়ে টাকা ভাঙাতে আপনাকে বেশ বেগ পেতে হবে।
চ্যাংড়াবান্দা থেকে সরাসরি ময়নাগুড়ির বাস ধরে দেড় ঘণ্টায় পৌঁছে যাবেন শীর্ষেন্দু-সমরেশের উপন্যাসখ্যাত শিলিগুড়ি জিপ স্টেশনে। ভাড়া জনপ্রতি ৭০ ভারতীয় রুপি। সেখান থেকে ঝটপট ১২০ ভারতীয় রুপির বিনিময়ে সংগ্রহ করে নিন দার্জিলিংগামী কমান্ডার জিপের টিকিট। হাতে শীতের পোশাক নিয়ে বসে পড়–ন আপনার নির্ধারিত আসনে। ব্যস, মাত্র আড়াই ঘণ্টায় আপনি পৌঁছে যাবেন মেঘের দেশ স্বপ্নিল ভুবনের দার্জিলিংয়ে।
তাছাড়া কলকাতা থেকে যেতে চাইলে আপনাকে শিয়ালদহ রেলওয়ে স্টেশন থেকে সন্ধ্যা ৭টা ১৫ মিনিটের দার্জিলিং মেল ধরতে হবে। টিকিট সংগ্রহ করবেন ট্যুরিস্টদের জন্য নির্ধারিত কাউন্টার ফেয়ারলি প্যালেস থেকে। অতঃপর প্রায় ৫৭৬ কিলোমিটার অর্থাৎ ১৪ ঘণ্টার এক ট্রেন ভ্রমণ করে পরদিন সকাল ১০টা নাগাদ নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে পৌঁছে যাবেন। স্টেশন থেকে প্রাতঃরাশ সম্পন্ন করে রিকশাযোগে চলে আসুন শিলিগুড়ি জিপ স্টেশনে। ১০-১২ রুপি ভাড়া পড়বে। সেখান থেকে ওই কমান্ডার জিপে চড়ে পৌঁছে যেতে পারেন স্বপ্নপুরী দার্জিলিংয়ে।
1408683091.
কোথায় থাকবেন?
পুঞ্জীভূত মেঘের কণা ভেদ করে আঁকাবাঁকা পথের ধারে পুরো দার্জিলিং শহরে রয়েছে অসংখ্য আবাসিক হোটেল। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হোটেলে প্রতিদিনের থাকা এবং খাওয়াসহ জনপ্রতি ভাড়া প্রায় ৮৫০-১২০০ রুপি করে। প্রায় প্রতিটি হোটেলেই রয়েছে দর্শনীয় স্থানসমূহ ঘুরে বেড়ানোর জন্য আকর্ষণীয় জিপ, সার্বক্ষণিক গরম পানির ব্যবস্থা, ঠাণ্ডা প্রতিরোধে ওষুধসহ যে কোন মুহূর্তে যে কোন সমস্যার তাৎক্ষণিক সেবা।
খাবার-দাবার
ট্যুরিস্টদের জন্য হোটেলগুলোতে সব ধরনের খাবারের ব্যবস্থা করা হয়। ফলে পুষ্টিকর ও রুচিসম্মত খাবার নিয়ে দুশ্চিন্তার কিছু নেই। বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর অসংখ্য ট্যুরিস্টের আগমনের ফলে এখানকার হোটেল মালিকরা বাংলাদেশীদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থায় একেবারে বাঙালি রুচিসম্মত খাবার-দাবারের জোগান দিয়ে থাকেন। ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ এবং ডিনার ছাড়াও হোটেল কর্তৃপক্ষ ভোরবেলায় বেড-টি এবং ডিনারের আগে ইভনিং-টি’র ব্যবস্থাও করে থাকেন।
darjeeling-toy-train
কোথায় বেড়াবেন?
ছোট বড় মিলিয়ে বেড়ানোর জন্য প্রায় ১৭টি আকর্ষণীয় স্থান রয়েছে দার্জিলিং জুড়ে। পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচুতে অবস্থিত রেলওয়ে স্টেশন ‘ঘুম’ ছাড়াও আরও যেসব দর্শনীয় স্থান দেখে আপনার আনন্দময় অভিজ্ঞতা অর্জিত হবে তা হচ্ছে;
সমুদ্র-পৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১০,০০০ ফুট উঁচু পাহাড়ের চূড়া থেকে অপূর্ব সুন্দর সূর্যোদয় দেখা। পৃথিবীর বিখ্যাত প্রার্থনা-স্থান ঘুম মোনাস্ট্রি। ছবির মতো অপূর্ব সুন্দর স্মৃতিসৌধ বাতাসিয়া লুপ বিলুপ্ত-প্রায় পাহাড়ি বাঘ Snow Lupard খ্যাত দার্জিলিং চিড়িয়াখানা। পাহাড়ে অভিযান শিক্ষাকেন্দ্র ‘হিমালয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ইন্সটিটিউট’।
সর্বপ্রথম এভারেস্ট বিজয়ী তেনজিং-রক- এর স্মৃতিস্তম্ভ। কেবল কারে করে প্রায় ১৬ কিলোমিটার এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ে ভ্রমণ।
হ্যাপি ভ্যালি টি গার্ডেনে বসে তাৎক্ষণিকভাবে পৃথিবীখ্যাত ব্ল্যাক টি পানের অপূর্ব অভিজ্ঞতা।
যুদ্ধবিধ্বস্ত শরণার্থী কেন্দ্র তিব্বতিয়ান সেলফ হেলপ্ সেন্টার। সমুদ্র-পৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৮,০০০ ফুট উঁচুতে অবস্থিত মনোরম খেলাধুলার স্থান দার্জিলিং গোরখা স্টেডিয়াম।
নেপালি জাতির স্বাক্ষর বহনকারী দার্জিলিং মিউজিয়াম। পৃথিবীর বিখ্যাত বৌদ্ধ বিহার জাপানিজ টেম্পল ব্রিটিশ আমলের সরকারি নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র কাউন্সিল হাউস ‘লাল কুঠির’ অসাধারণ শৈল্পিক নিদর্শন খ্যাত ‘আভা আর্ট গ্যালারি’। শতবর্ষের প্রাচীন মন্দির ‘দিরদাহাম টেম্পল’। এসব নিদর্শন ছাড়াও আপনার মনের চিরহরিৎ জগতকে শুধু আনন্দময় নয়, এক নতুন জীবনের যাত্রা শুরু করাতে চলে যেতে পারেন পাথর কেটে তৈরি ‘রক গার্ডেন’ এবং গঙ্গামায়া পার্কে উপরোল্লিখিত দর্শনীয় স্থানগুলো ছাড়াও আপনার হদয় গহিন থেকে রোমাঞ্চিত করবে মহান সৃষ্টিকর্তার বিশাল উপহার হিমালয় কন্যা ‘কাঞ্চন-জংঘা’, বিশুদ্ধ পানির অবিরাম ঝর্ণাধারা ‘ভিক্টোরিয়া ফলস্’ এবং মেঘের দেশে বসবাসরত এক সুসভ্য জাতির সংস্কৃতি।
darjeeling-bigimage
কেনাকাটা
দার্জিলিং শহরের লাডেন-লা রোডের কোল ঘেঁষে রয়েছে অসংখ্য ছোট-বড় মার্কেট। দৈনন্দিন জীবনের ব্যবহার্য প্রায় সব জিনিসই আপনি পেয়ে যাবেন আপনার ক্রয়- ক্ষমতার মধ্যে। সবচেয়ে ভালো পাবেন শীতের পোশাক। হাতমোজা, কানটুপি, মাফলার, সোয়েটারসহ যে কোন প্রকারের লেদার জ্যাকেট পেয়ে যাবেন আপনার পছন্দমতো মূল্যে। তাছাড়া ১০০ থেকে ৫০০ রুপির মধ্যে পেয়ে যাবেন অসাধারণ কাজ করা নেপালি শাল এবং শাড়ি যা আপনার পছন্দ হতে বাধ্য। প্রিয়জনকে উপহার দিতে সর্বনিু ২০ রুপি থেকে ২৫০ রুপির মধ্যে পেয়ে যাবেন বিভিন্ন অ্যান্টিক্স ও নানাবিধ গিফট আইটেম, যা আপনার প্রিয়জনের ভালোবাসা কেড়ে নিতে সক্ষম। তাছাড়া আকর্ষণীয় লেদার সু আর বাহারি সানগ্লাস তো আছেই। কেনাকাটা করতে গিয়ে প্রতারিত হওয়ার আশংকা একেবারেই নেই। তবে হোটেলগুলোতে কিছু নেপালি তরুণ-তরুণী ভ্রাম্যমাণ ফেরি করে শাল, শাড়ি বিক্রয় করে থাকে। তাদের কাছ থেকে না কেনাটাই উত্তম।
ঝুঁকি
মানুষের জীবনটাই একটা বড় ঝুঁকি। তার পরেও সাবধানতা অবলম্বন করে ঝুঁকি এড়িয়ে স্বাচ্ছন্দ্যে বেঁচে থাকার প্রয়াস পেয়েছে মানুষ দীর্ঘকাল। দার্জিলিং ভ্রমণেও ছোটখাটো কিছু ঝুঁকি রয়েছে। মাঝে-মাঝেই পাহাড়ি অঞ্চলে ছোটখাটো ধস নামে। তবে সেটা বেশি হয় বর্ষা মৌসুমে। শীত বা গরমে সে ঝুঁকিটা একেবারেই নেই। আর গরম জামাকাপড় ব্যবহারে অবহেলা না করলে ঠাণ্ডা লাগার ঝুঁকিটাও কমে যায় একেবারেই। তাছাড়া হোটেল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সবরকম বিষয়ে পরামর্শ করে চলাফেরা করলে স্থানীয় দালাল বা হারিয়ে যাওয়ার আশংকা থেকেও আপনি পেয়ে যাবেন পুরোপুরি মুক্তি।
মোট খরচ
স্বল্প খরচে, অল্প আরামে মনটাকে মানিয়ে নিতে পারলে শীত মৌসুমে মাত্র ১০,০০০ টাকার মধ্যেই আপনি সেরে নিতে পারেন স্বপ্নপুরী দার্জিলিং দেখার যাবতীয় কার্যক্রম। ভালো কথা, এ হিসাবটা শুধু বুড়িমারী সীমান্ত পথের। কলকাতার শিয়ালদহ হয়ে গেলে এ হিসাব বেড়ে দাঁড়াবে সর্বসাকুল্যে ১৫০০০ টাকায়। আমাদের দেশে রয়েছে অসংখ্য ট্যুরিজম কোম্পানি, যারা দার্জিলিংসহ বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে প্যাকেজ ট্যুরের আয়োজন করে থাকে।
1408683544.
আশপাশে
দার্জিলিং শহর থেকে কিছুটা দূরে নেপাল শহরের নিকটবর্তীতে অবস্থান করছে মিরিক লেক ও পশুপতি মার্কেট। সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টার মধ্যে জনপ্রতি ৪৫০ রুপি ভাড়ার মধ্যে আকর্ষণীয় জিপে ঘুরে আসতে পারেন। সেজন্য অবশ্য আরও একটি দিন বেশি অতিবাহিত করতে হবে দার্জিলিং শহরে। তবুও যাত্রার দিন থেকে নিয়ে সর্বমোট ৫ দিনেই সবকিছু ঘুরে-ফিরে আসতে পারবেন আপনার প্রিয়জনদের মাঝে অপূর্ব স্বপ্নিল অভিজ্ঞতা নিয়ে।